Wednesday 23 June 2021

সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে গার্ড অব অনারে নারীর বিকল্প

 বীরমুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প খুজার ভাবনা; সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে কি বলে আজকে সেটাই আলোচ্য বিষয়।।

কবি বলেছেন, বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছি নারী, অর্ধেক তার নর।
সরকারের নীতি মালা অনুযায়ী, কোনো বীরমুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার পর তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানায় সংশ্লিষ্ট জেলা/উপজেলা প্রশাসন। ডিসিবাইউএনও সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে থাকেন। কফিনে সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী কর্মকর্তা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

অনেক স্থানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে নারী কর্মকর্তারা রয়েছেন, আর সেখানেই আপত্তি তুলেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

গত ১৩ জুন, রোববার সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা ওঠার পর সরকারের কাছে সুপারিশ রাখা হয়েছে গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প খুঁজতে।

সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “বীরমুক্তিযোদ্ধাদের ‘গার্ড অব অনার’ প্রদানের ক্ষেত্রে দিনের বেলায় আয়োজন করা এবং মহিলা ইউএনওর বিকল্প ব্যক্তি নির্ধারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।”(তথ্যসূত্র :বিডিনিউজ২৪.কম)
চারদিক থেকে যখন আমরা নারীদের এগিয়ে যাওয়ার খবর শুনি ঠিক এইসময়ে এইরকম একটি দুঃখজনক খবর আমাদের সত্যিই ব্যথিত করে। এটি একাধারে যেমন চরম নারীবিদ্বেষী তেমনি বৈষম্যমূলক আবার রাষ্ট্রের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে আমরা দেখব, যে চারটি মূলনীতির কথা বলা হয়েছিলো তারমধ্যে একটি হলো গণতন্ত্র। একটি রাষ্ট্রের অর্ধেক জনগণের প্রতি বৈষম্য করে কিভাবে একটি রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়? সেটা খুব সহজেই অনুমান করা যায়। যদি আপনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান তাহলে অবশ্যই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিককে সমান অধিকার চর্চার সুযোগ দিতে হবে। সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে কিছু লাইনআমি হুবহু তুলে ধরছি।

লাইনগুলো নিম্নরুপ:
আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকসাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে। এখানে, উল্লিখিত অধিকার গুলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প খুজার কথা বলার অর্থ হলো আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার ধারণাকে অস্বীকার করা। নারীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে কিভাবে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়? শুধু তাই নয়, একইসাথে আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, সামাজিকসাম্য এবং সুবিচার এই বিষয়গুলোর সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প খুজার ভাবনাটি।
আসা যাক,সংবিধানের ১৯(৩) অনুচ্ছেদে, যেখানে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে,
জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প খুজার ভাবনাটি ১৯(৩) অনুচ্ছেদের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকলসময়েজনগণেরসেবাকরিবারচেষ্টাকরাপ্রজাতন্ত্রেরকর্মেনিযুক্তপ্রত্যেকব্যক্তিরকর্তব্য৷আমরাএইঅনুচ্ছেদথেকেবলতেপারিগাগার্ড অব অনারে নারীদের অংশগ্রহন করতে না দেওয়ার মানে হলো তাকে তার কর্তব্য পালনে বাধা দেওয়া।
অনুচ্ছেদ ২৭-এ বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। কিন্ত, এখানে আমরা এই অনুচ্ছেদের প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছিনা। একইসাথে,অনুচ্ছেদ ২৮-এ উল্লিখিত ধর্ম, প্রভৃতি কারণে বৈষম্য না করার নীতিটির সাথেও সাংঘর্ষিক আমাদের এই মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প খুজার ভাবনাটি। একই সাথে, রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারীপুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন। [অনুচ্ছেদ ২৮ (২)]
অনুচ্ছেদ ২৯ (১) এ বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ – লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। সুতরাং, এই বিধানটির মারাত্মক অবমাননা হয়েছে
মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প খুজার ভাবনাটির মাধ্যমে।
শুধু তাই না,আমাদের সংবিধান যেখানে নারীদের এগিয়ে আনার জন্য Positive Discrimination নীতির এবং নারী নেতৃত্ব কে সামনে আনার জন্য নারীদের জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করেছে সেইখানে যদি নারীর প্রাপ্য অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয় তখন আমাদেরকে অবশ্যই এই সিদ্ধান্তকে একটি নারীবিদ্বেষী সিদ্ধান্ত বলতে হবে।
Mosammat Nasrin Akhter and others vs. Bangladesh and others [‘Gender Discrimination in Public Employment’ Case] এটি একটি লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ মামলা।
নিচে কিছু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিল দেখাচ্ছি যেগুলো নারীর অধিকারকে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছে।

Universal Declaration of Human Rights.

International Covenant on Economic, Social and Cultural Rights.(অনুচ্ছেদ ২, ৩ এবং ৭)

International Covenant on Civil and Political Rights.( অনুচ্ছেদ ২, ৩ এবং ২৬).

European Social Charter.( অনুচ্ছেদ ৪ এবং ৮)

European Social Charter (revised)[ অনুচ্ছেদ ৪ (৩), ৮ এবং ২৭]

Inter-American Convention on the Prevention, Punishment and Eradication of Violence Against Women.

Inter-American Convention on the Nationality of Women.

Inter-American Convention on the Granting of Civil Rights to Women.

African Charter on Democracy, Elections and Governance.( অনুচ্ছেদ ৮ (২),২৯ এবং ৪৩)

African Charter on Human and Peoples’ Rights [অনুচ্ছেদ ১৮ (৩)]

African Charter on the Rights and Welfare of the Child (অনুচ্ছেদ ১৪)

American Convention on Human Rights [অনুচ্ছেদ ১ (১), ৬ (১) এবং ২৭ (১)]

American Declaration of the Rights and Duties of Man (অনুচ্ছেদ ২ ও ৭)

Arab Charter on Human Rights (অনুচ্ছেদ ৩, ৪, ১০, ৩৩, ৩৪, ৪৩)

Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women.

Convention on the Nationality of Married Women.

Convention on the Political Rights of Women.

Convention for the Suppression of the Traffic in Persons and of the Exploitation of the Prostitution of Others.

Council of Europe Convention on Preventing and Combating Violence against Women and Domestic Violence.(ইস্তানবুল কনভেনশন)

European Convention for the Protection of Human Rights and Fundamental Freedoms.

পরিশেষে বলতে চাই, একটি জাতির অর্ধেক জাতিকে পিছনে ঠেলে দিয়ে, অবহেলা করে,তাদের অধিকারকে অস্বীকার করে কখনো একটি জাতি এগিয়ে যেতে পারেনা। দেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীইউএনওদের বিকল্প খুজার প্রস্তাবটি কোনভাবেই যেন কার্যকর করা না হয় তার জোর দাবি জানাচ্ছি।

প্রযুক্তিগত বোকামি ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত

  ইন্টারনেট ১৯৬৯ সালে আবিস্কৃত হয়। গত ১৯৯৫ সালে ইন্টারনেট বাণিজ্যিক বা কর্পোরেট পন্য হিসেবে আবির্ভূত হয়ে চলমান রয়েছে। গত ১৯৯০ দশকে টেলিফো...