Wednesday, 23 June 2021

প্রযুক্তিগত বোকামি ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত

 ইন্টারনেট ১৯৬৯ সালে আবিস্কৃত হয়। গত ১৯৯৫ সালে ইন্টারনেট বাণিজ্যিক বা কর্পোরেট পন্য হিসেবে আবির্ভূত হয়ে চলমান রয়েছে। গত ১৯৯০ দশকে টেলিফোন প্রযুক্তি ডায়াল-আপ মাধ্যমে শুরু হলেও, প্রযুক্তির গতিময় উৎকর্ষতার কারণে, একবিংশ শতাব্দির প্রথম দশকে দ্রুতগতির ব্রডবেন্ড ইন্টারনেট বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বে প্রায় ৪.৭ বিলিয়ন লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করে। দিনদিন উপযোগিতা ক্রমবর্ধমানহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গড়ে প্রতিজনে প্রতিদিন সাড়ে ০৬ ঘন্টার মতো এই স্পেসে সরব ও বিদ্যমান থাকে। বিশ্বের সর্বাধিক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মহাদেশ হচ্ছে এশিয়া। মোট ব্যবহারকারীদের প্রায় ৪৯.৭% ব্যবহার করেন এশিয়ার লোকজন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইউরোপ। তাঁরা ব্যবহার করে প্রায় ১৬.৪৮% জন। আফ্রিকা ১১%জন, লাতিন আমেরিকা-ক্যারাবিয়ান ব্যবহার করেন ১০.৪% এবং উত্তর আমেরিকা ব্যবহার করেন ৮.২% জন। এই হচ্ছে মোটামুটি খসড়া হিসাবের একটি চিত্র।

বিশ্বে প্রায় ৫.১৯ বিলিয়ন মানুষ মোবাইল ডিভাইস ব্যবহার করে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় এর প্রায় ৮০% হচ্ছেন নিজেই সেলফোনের মালিক। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫১% লোক মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে অনলাইন বা সাইবারস্পেস ইউজ করে। বিশ্বব্যাপী ২.২৭ বিলিয়ন লোক কমবেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন। ফেইসবুক ইউজার ২.২৭ বিলিয়ন এবং ইনস্টগ্রাম ইউজার ০১ বিলিয়ন। ফলে সহজেই অনুমেয় ব্যবহারকারীদের হার বাড়ছে এবং বাড়বে।গত দুইদশকে এই সংখ্যা জ্যামিতিক তথা মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগের উন্নতর নতুন মাত্রা সন্নিবেশিত হয়েছে। বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা ইন্টারনেটের আওতাধীনে ইতোমধ্যে এসেছে। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যতিত জীবন আজ প্রায় অচল। তথ্য-প্রযুক্তি ছাড়া দিনপার অসম্ভব। এর ফলে মানুষের জীবন-জীবিকা সহজ হয়েছে। গতিময় ও বর্ণিল হয়েছে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এই যুগে বাংলাদেশও সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশে ১৯৯৩ সালে ইন্টারনেট চালু হয়। সবার জন্যে উম্মুক্ত হয় ১৯৯৬ সালে। শুরুর দিকে কচ্ছপ গতিতে ইন্টানেটের ব্যবহার বাড়লেও, পরবর্তীতে তা তীব্রগতিতে বাড়তে থাকে। এখনও বাড়তেই আছে। বাংলাদেশে প্রকৃত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ০৩ কোটি ৫০ লক্ষ। গড়ে প্রতি ০৫ জনে ০১ জন ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। উল্লিখিত হিসাব হচ্ছে মোবাইল অপারেটরদের হিসাব। তবে সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে ০৮ কোটি ০৮ লক্ষ লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এই হিসাব ২০১৮ সালের। ব্যবহারকারী রেকর্ডসংখ্যক হারে বেড়ে বর্তমানে ১০ কোটি ৬৪ লক্ষ ১০ হাজারে উপনীত হয়েছে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের কল্যাণে অনেক কিছুই আবিষ্কৃত হচ্ছে। প্রতিটি আবিষ্কারের দুটি দিক পরিলক্ষিত হয়। তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও তাই। ভালো-মন্দ অর্থাৎ সুবিধা-অসুবিধা। এমন কী এর ব্যবহার ও অপব্যবহার। যথোপযুক্ত ব্যবহার অগুনিত,অসীম বলা চলে। কিন্তু এর অপব্যবহারে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। শিশু-কিশোর গেমে আসক্ত। কিশোর অপরাধী গ্যাং সৃষ্টি। তরুণেরা পর্ণগ্রাফিতে দিনরাত নিমজ্জিত। পাশাপাশি সাইবার অপরাধ বেড়েছে। দেশে দেশে সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ উগ্র-মৌলবাদীগোষ্ঠী ধর্মের ঠুনকো, খুড়া এবং নিকৃষ্ট অজুহাতে সাইবার জগতকে কেন্দ্র করে ব্যক্তি, গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের উপর হামলা করছে। অনগ্রসর দেশ, ক্ষেত্রবিশেষে তথাকথিত উন্নত-অনুন্নত দেশেও নিয়ত এই হামলা-মামলা, পাল্টা হামলা অব্যাহত রয়েছে। ফলে আতঙ্কিত না হয়ে নিস্তার বা নিষ্কৃতি নেই। সাম্প্রদায়িক হামলার পেক্ষাপট এবং এর কদর্য ব্যবহার বা ধরণ বিশ্লেষণ কিম্বা আলোকপাত করলে, অবশ্যই প্রতিরোধ ও প্রতিকার নিয়ে ভাবতে হবে এবং তৎসংশ্লিষ্ট জনগুরুত্বপূর্ণদের সর্বাগ্রে সচেতনতাসহ সোচ্চার হতে হবে।

প্রসঙ্গত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের নির্মোহ চিত্তে দৃষ্টিপাত করলে আমাদেরকে কতিপয় সংঘটিত ঘটনা উল্লেখ করতেই হয়। গত ১৭ ডিসেম্বর ২০১০ খ্রিস্টাব্দ। তিউনিসিয়ার বেন আরাস শহরে তার ছোট টাঙা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছেন ফলবিক্রেতা তারেক এল তায়েব মোহাম্মদ বুয়াজিজি। ধারে পন্য কিনে বিক্রি করে সন্ধ্যায় পাওনাদারের পাওনা পরিশোধ করেন। যৎসামান্য আয় দিয়ে চালান সংসার। সকাল সাড়ে দশটার দিকে তার টাঙাটিকে আটক করে পুলিশ। তার অপরাধ তিনি পুলিশকে চাঁদা দেন নি। তিনি পুলিশকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, তার হাতে কোনো টাকা নেই। পন্যগুলো সম্পূর্ণ ধারে কেনা। কিন্তু পুলিশ সে কথায় কান দেয় নি। ছুড়ে ফেলে দেয় তার ওজন পরিমাপক যন্ত্রটি।জব্দ করে তার বিক্রয়পন্য। এটা করেও থামেনি পুলিশ, তারা তাকে চড় লাথি মারে। গায়ে থুঁথুঁ ছিটিয়ে দেয়। এমনকি তাঁর মৃত বাবাকে তুলেও গালি দেয়। একদিকে মাথার উপর কর্জের বোঝা। অন্যদিকে পেটে লাথি। ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় বুয়াজিজি ছুটে গেলেন গভর্নরের অফিসে। কিন্তু গভর্নর দেখা দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। বুয়াজিজি চিৎকার করে বলেন, ‘আমার কথা না শুনলে আমি গায়ে আগুন ধরিয়ে দেব’। না,তাতেও কাজ হয়নি। তারপর বুয়াজিজি ছুটে যায় পার্শ্ববর্তী একটি গ্যাস স্টেশনে। কৌটাভর্তি গ্যাসেলিন এনে গভর্নর অফিসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শরীরে ঢেলে, তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। তখন বেলা সাড়ে ১১টা। দ্রুত লোকজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসক বলেন-তাঁর শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে। দীর্ঘ ১৮ দিন অসহ্য যন্ত্রনায় দগ্ধ হয়ে অবশেষে না ফেরায় পাড়ি জমালেন বুয়াজিজি; এখানেই শেষ নয়। বুয়াজিজি শরীরের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে এবং দেশ হতে দেশান্তরে। আর তাতে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে গেল আরব বিশ্বের বিশেষত উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশের জনতার উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা স্বৈরশাসকের তক্ত হাউস। আরব বিশ্বের দেশে দেশে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণমানুষের নব জাগরণকে মিডিয়া অভিহিত করেছে ‘আরব বসন্ত’ হিসেবে। এই আন্দোলন সংঘটনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে যুব সমাজ। বেকারত্ব, দারিদ্র, দুর্নীতি, উচ্চ শিক্ষায় সুযোগের সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি নানান সমস্যায় জর্জরিত যুবসমাজ ফেইসবুক,ইউটিউব ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে একটি সর্বজনীন লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্ত সর্বস্তরের মানুষকে একটি প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসেছিল। এভাবে তাদের বার্তা, তাঁরা শুধু নিজেদের মধ্যেই ছড়িয়ে দেয়নি। তাদের বার্তা রাষ্ট্রীয় সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী তাদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন আদায়েও সফল হয়েছিল। একদল মিশরিয় ও তিউনিসিয়দের উপর পরিচালিত একটি জরিপে তাদের প্রশ্ন করা হয়- ‘২০১১ সালের প্রারম্ভে সংঘটিত ঘটনা প্রবাহের সময় তাঁরা কী উদ্দেশ্যে ফেইসবুক ব্যবহার করেছিল?’ শতকরা ৮৫জন উত্তর দিয়েছিল, ‘তথ্য প্রবাহ সঞ্চালন ও সচেতনতা বিস্তারের মাধ্যমে বিপ্লব সংঘটনের উদ্দেশ্যে।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রবল বিস্তার,আর মানুষের রাজনৈতিক মতাদর্শ বিনির্মাণে তার ব্যাপক ক্ষমতার কারণে তাকে প্রপাগান্ডার, বিশেষ করে সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে ধর্মীয় প্রপাগান্ডার এক বিশাল হাতিয়ারে পরিনত করেছে। স্মার্টফোনের স্বল্পমূল্য, বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ব্যবহারের সহজ সুযোগ এবং স্বল্প ব্যয়ে সাধারণ মানুষের তৈরি উপাদান দিয়ে ব্যবহারের সুযোগ ইত্যাদি কারণে এটি অল্প সময়ে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মতো তথ্য-উপাত্তের জন্যে কোনো এলিট নেটওয়ার্কের উপর নির্ভর করতে হয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সবচেয়ে কার্যকর দিক হল-ব্যবহারকারী বিষয়বস্তু থেকে নিজের পছন্দমতো অংশ রেখে, বাকী অংশ ছেঁটে বাদ দিতে পারেন এবং সামান্য প্রচেষ্টায় তা-বহু লোকের নিকট পৌঁছে দিতে পারেন। সরকারি এজেন্সি, রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মী, স্বার্থান্বেষী মহল; এমনকি একজন সাধারণ মানুষও এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। অনেক সময় লকড বা ছদ্ধবেশী আইডি খুলে বিদ্বেষমূলক পোস্ট দিয়ে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় ধর্মীয় অনূভূতিতে আঘাত করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করা হয়।

গত ২০০৯ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আবির্ভাব ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ব্যপকভাবে বদলে দিতে থাকে। গত ২০১৪ সালে ভারতের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসীন হলে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তখন ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, তাকে ভারতের প্রথম ’হোয়াটস অ্যাপ প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে অবিহিত করে। ২০১৫ সাল থেকে হোয়াটস অ্যাপ এবং টুইটারের ন্যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভারতের সংখ্যা লঘুদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে উত্তর ভারতে সংখ্যালঘূ, সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে, দাঙ্গা সৃষ্টিতে ক্রমবর্ধমান ভূমিকা পালন করে আসছে। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং ওয়েব সাইট এর প্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা বলেন ’ভারতের হোয়াটস অ্যাপ ব্যবহারকারীদের অধিকাংশ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত পল্লী অঞ্চলের মানুষ তাদের ইন্টারনেট জ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায়। তাঁরা জানেনা কী কী বিশ্বাস করতে হবে। তাই তাঁরা খুব সহজে গুজবে বিশ্বাসী হয়ে উঠে’। ভারতীয় সাংবাদিক নিলম সরকার ২০২০ সালের ০৪ মার্চ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলেন-‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম স্থানীয় সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও জাতীয় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মধ্যকার ব্যবধান অবিশ্বাস্য রকম কমিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে একটি স্থানীয় সাম্প্রদায়িক সংঘাতকে মূহুর্তে জাতীয় ইস্যুতে পরিনত করা যায়। তিনি আরো বলেন-‘ দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা একটি দলকে আসাম বা পশ্চিম বাংলায় নির্বাচনী বৈতরনী পার হতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। গত ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতে উত্তর প্রদেশের দাদরিতে গো-মাংশ ভক্ষনের কথিত অভিযোগে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হামলায় মোহাম্মদ আখলাক নামের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন নিহত হন।
হামলায় তাঁর পুত্র মোহাম্মদ দানিশ মাথায় গুরুতর আঘাতের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। দাদরি হত্যাকান্ডের সঙ্গে-সঙ্গেই মুসলমানদের কর্তৃক গো-মাংস ভক্ষনের খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হতে থাকে। দাদরি হত্যাকান্ডের অভিযুক্ত একজনের বোন সাক্ষাৎকারে বলেন- ‘তার ও তার ভাই এর হোয়াট’স অ্যাপে গো-হত্যার খবর বানের বেগে আসতে থাকে। ভিডিওগুলো কাশ্মির, মুজাফফরনগর এবং অন্যান্য মুসলিম এলাকার, এগুলো দেখে বেশ কষ্ট পাচ্ছিলাম । আরেকজন অভিযুক্তের ভাই বলেন ‘টিভি কাভারেজের কারণে গো-হত্যা বন্ধের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠি। সাথে সাথে ফেইসবুক ফিডে গো-হত্যার ভিডিও আসতে থাকে। এরপর ফেইসবুকে ‘গো সেবা ট্রাস্ট’ নামক রুগ্ন গরুদের সেবা প্রদানকারী একটি সংগঠনের একটি পোস্ট দেখে সেটি ফলো করি। এর পরই নিয়মিত আপডেট আসতে শুরু করে।
২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি জম্মু-কশ্মিরের কাঠুয়ায় যাযাবর বাকারওয়াল সম্প্রদায়ের ১০ বছর বয়সী বালিকা আসিফা নিখোঁজ হয়। তাঁর আগে স্থানীয় উগ্রপন্থী হিন্দুরা বাকারওয়ালদের এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বলে। নিখোঁজের এক সপ্তাহ পরে গ্রাম থেকে মাইলখানেক দুরে আসিফার মৃতদেহ দেখতে পায় গ্রামবাসী। আসিফাকে অপহরনের পর স্থানীয় একটি মন্দিরে ০৭ দিন আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করে দূর্বৃত্তরা। উক্ত ঘটনায় জড়িত ছিল মন্দিরের পুরোহিত সানজি রাম, তার কিশোর ভ্রাতুস্পুত্র এবং কয়েকজন পুলিশ সদস্য। কাঠুয়ার ঘটনার পর ক্ষমতাসীন বিজেপির আইটি সেল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। প্রথমতঃ তারা বলে যে, আসিফা আদৌ ধর্ষিত হয় নি। তারপর একটি কাল্পনিক ময়নাতদন্ত রিপোর্টের কথা ছড়িয়ে বলে, ময়নাতদন্তে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। একইসঙ্গে ছড়াতে থাকে মেহবুবা মূফতি সরকার, হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিয়ে নিরপরাধ ব্যাক্তিদের মামলায় জড়িয়েছে। এসব প্রপাগান্ডা ছড়ানোর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল- একটি সাম্প্রদায়িক উস্কানীর মাধ্যমে দেশকে বিভক্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল ।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর ক্ষেত্রে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের প্যাটার্ন প্রায় একইরকম। এখানে সংখ্যালঘূ সম্প্রদায়ের কারো নামে ভূয়া আইডি খুলে অথবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কারো আইডি হ্যাক করে, তাতে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনূভূতিতে আঘাত সৃষ্টিকারী কোনো পোস্ট দিয়ে সম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে দাঙ্গা বাঁধানো হয়। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন অবমাননাকর একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে ২০১২ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলায় দাঙ্গাকারীরা হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে ১২টি মঠ, উপাসনালয় এবং ধ্বংসজজ্ঞ ও লুটতরাজ চালায় বৌদ্ধদের ৫০টি বাড়ি। ক্রমে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী উখিয়া এবং চট্রগ্রামের পটিয়া উপজেলায় এবং লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয় সংখ্যালঘু বৌদ্ধ এবং হিন্দুদের বাড়িঘর উপাসনালয় এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ছদ্মনামে খোলা একটি আইডি থেকে পোস্টটি ট্যাগ করা হয়, স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী উত্তম কুমার বড়ুয়ার ওয়ালে আর সেখান থেকেই দাঙ্গার সূত্রপাত। গত ২০১৬ সালে বি-বাড়ীয়া জেলায় নাসির নগর উপজেলায় সংঘটিত দাঙ্গার সূত্রপাতও একটি ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে। উপজেলায় হরিনবেড় গ্রামে রসরাজ দাস নামে এক নিরক্ষর জেলের ফেইসবুক একাউন্ট থেকে ইসলাম ধর্মের সে অবমাননাকারী সেই পোস্টটি করা হয়। আর তার জের ধরেই ৩০ অক্টোবর রাত ০৩টায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপসানালয়, বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়। প্রায় ৩০০০ দাঙ্গাকারী অংশগ্রহণ করে। দাঙ্গায় ধ্বংস হয় ১২টি মন্দির, বেশ কয়েকটি কালি পূঁজার মন্ডপ, শতাধিক ঘরবাড়ি এবং আহত হয় সংখ্যালগু সম্প্রদায়ের শতাধিক মানুষ। এই হামলার পূর্বে স্থানীয় খেলার মাঠে দাঙ্গাকারীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সেই সমাবেশে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান করে স্থানীয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত, হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলাম ও ক্ষমতাসীন আওয়ামিলীগ নেতৃবৃন্দ। দাঙ্গার আগে ও পরে কয়েকটি ওয়েবসাইট, ফেইসবুক পেইজ ও গ্রুপ দাঙ্গাকারীদের পক্ষে প্রচারণা চালায়। গ্রেপ্তারের পর রসরাজকে পুলিশ হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে রসরাজ লিখতে ও পড়তে জানে না। এমনকি তার ফেইসবুক আইডির পাসওয়ার্ড ও তার জানা নেই ।

অতিসম্প্রতি ১৭ মার্চ (বুধবার), সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লায় একটি হিন্দু অধ্যুষিত নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট চালিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ নামের অ-মানুষ। হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হককে নিয়ে হিন্দু ব্যক্তির ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেয়ায় এই নির্মম হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। প্রায় ৮০০ এর অধিক ঘরবাড়ি ও ০৮টি মন্দির ভাংচুর হয়। এবং ব্যাপক লুটতরাজ চলে। আক্রমন চলাকালে আতঙ্কিত হয়ে গ্রামবাসীরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। বাংলাদেশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশনের দেওয়া তথ্যমতে গত ০৫ বছরে দেশে ০১ হাজার ৪০০ চেয়েও অধিক সাইবার হামলা হয়েছে। জঙ্গিবাদ,উগ্রবাদিতা সাইবারস্পেস ব্যবহারের মাধ্যমেই ছড়াচ্ছে।সাইবার অপরাধ প্রতিরোধের উপায় প্রথমত ব্যক্তিগত সচেতনতা এবং যাচাই-বাচাইক্রমে যেকোনো তথ্য-উপাত্ত গ্রহণ ও বর্জন। অর্থাৎ নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। এবং সাইবারস্পেস ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান ও ওয়াকিবহাল অতি জরুরি শর্ত। প্রতিরোধমুলক সুরক্ষা এর বাইরে খুব একটা নেই বললেই চলে। প্রতিকার হিসেবে রাষ্ট্রীয় বিদ্যমান আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর ও কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬; পর্ণগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন,২০১০ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ অনুযায়ী প্রতিকার গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।

অর্ধশতবর্ষ আগে, একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী, শোষণহীন এবং মানবিক সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে বাংলার মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছিল মুক্তির সংগ্রামে। ঝলসে উঠেছিল অত্যাচারের কড়া চাবুক, ক্ষুধাতুর শিশু রুটির পরিবর্তে পেয়েছিল তপ্ত বুলেট, আর বোনের সোনালি কাবিন ছিড়ে গিয়েছিল ঘাতকের নিষ্ঠুর বেয়নেটে। অবশেষে এক সাগর রক্ত পেরিয়ে আমরা পৌঁছি স্বাধীনতার সোনালি দ্বীপে। কিন্তু যে লড়াই আমাদের পূর্বসুরীরা শুরু করেছিল তা-শ্বাস্বত লড়াই। একটি সমৃদ্ধশালী, বহুত্ববাদী, মানবিক সমাজ গড়ার পূর্বশর্ত হল-সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি। আর সে লক্ষ্যে ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, মিডিয়াকর্মী, উন্নয়নকর্মী এবং বিভিন্ন মত ও পথের সাধারণ মানুষকে একটি প্ল্যাটফর্মে এসে সমবেত হতে হবে। সে জন্যে একটি শক্তিশালী আন্তঃধর্মীয় যোগাযোগ মাধ্যম সৃষ্টি করে নিয়মিত আন্তঃধর্মীয় সংলাপ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে বিভিন্ন ধর্মের মানবিক ও বহুত্ববাদী বার্তাকে তুলে ধরে, তা-সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এ সম্পর্কিত সাংবাদিক গবেষকদের লেখা পত্রিকায় প্রকাশ করে তা-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে হবে।পূর্বোক্ত প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রতি মাসে অন্তত: একটি যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ করতে হবে।যখনই কোনো অপশক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো কথিত গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির পায়তারা চালাবে, সঙ্গেই-সঙ্গেই সত্য উদঘাটন করে এবং মানুষের মানবিকবোধ জাগ্রত করে সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় তা-রুখতে হবে।

চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে অপরাধের সঙ্গে জড়িত শিশুর গন্তব্যে অবশ্যই শিশু আদালতই

 বাংলাদেশ শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষরকারী একটি দেশ। ১৯৭২ সনে অনেক অঙ্গীকারের সংগে মৌলিক মানবাধিকার ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতিতে আমাদের সংবিধান রচিত হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫এ আর্ন্তজাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৯(৪) এ শিশুদের জন্য বিশেষ বিধান করার কথা বলা হয়েছে। সে প্রেক্ষাপটে শিশু আইন, ২০১৩ প্রনীত হয়। আমাদের সংবিধানে ৩৩ অনুচ্ছেদে ২৪ ঘন্টার মধ্যে কোন গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট আনতে বলা হয়েছে। কিন্তু শিশু আইনে শিশুকে শিশু আদালতে হাজির করতে বলা হয়েছে। এটি কি সংবিধান বিরোধী হলো? সেজন্য সংবিধানের মৌলিক অধিকার অনুচ্ছেদের ২৯(৪) ও ৩৩ এবং ২৬ অনুচ্ছেদ এক সঙ্গে পড়তে হবে। অনুচ্ছেদ ২৬এ আছে, “ ২৬(১) এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসামঞ্জস্য সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে। (২) রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।”

অনুচ্ছেদ ২৬ এর ‘এই ভাগের বিধানাবলীর’ ও ‘এই ভাগের কোন বিধানের সহিত’, অনুচ্ছেদ ২৯(৪) এবং অনুচ্ছেদ ৩৩(২) এক সংগে পড়লে যা বুঝা যায়, অনুচ্ছেদ ৩৩ আগের অনুচ্ছেদ ২৯ সংবিধানে রয়েছে এবং মৌলিক অধিকার সমূহের গাইড লাইন হিসাবে অনুচ্ছেদ ২৬ রয়েছে। যার কারনে অনুচ্ছেদ ২৯ও ৩৩ কে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। সে কারনে শিশু আইন, ২০১৩ এর শিশুকে শিশু আদালতে ২৪ ঘন্টার মধ্যে হাজির করার বিধান সংবিধান বিরোধী নয়। শিশু আইন, ২০১৩ এর ৫২(৪) ধারায় আছে, “ (৪) গ্রেফতারকৃত শিশুকে উপ-ধারা (৩) এর অধীন জামিনে মুক্তি প্রদান করা না হইলে শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা, গ্রেফতারের পর আদালতে উপস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ভ্রমণ সময় ব্যতীত, ২৪(চব্বিশ) ঘন্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট নিকটস্থ শিশু-আদালতে হাজির করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। (৫) থানা হইতে জামিন প্রাপ্ত হয় নাই এমন কোন শিশুকে আদালতে উপস্থাপন করা হইলে শিশু আদালত তাহাকে জামিন প্রদান করিবে বা নিরাপদ স্থানে বা শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আটক রাখিবার আদেশ প্রদান করিবে।”

কিন্তু আইনের সংস্পর্শে আসা অর্থাৎ এমন কোন শিশু, যে বিদ্যমান কোন আইনের অধীনে কোন অপরাধের শিকার বা সাক্ষীকে শিশু আদালতে আনার কথা উক্ত আইনে নেই। এমনকি ২০১৮ সনে ৫৪নং আইন দ্বারা শিশু আইন, ২০১৩ এ কিছু সংশোধনী আনা হয়। শিশু আইনের ১৭ ধারায় আইনের সহিত সংঘাতে জড়িত শিশু বা আইনের সংম্পর্শে আসা শিশু কোন মামলা জড়িত থাকলেই ২০১৮ এর আগে শিশু আদালতে বিচারের এখতিয়ার ছিল। কিন্তু এখন ‘আইনের সংম্পর্শে আসা শিশু’ শব্দগুলো ২০১৮ সনের সংশোধনে বাদ দেওয়া হয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র আইনের সাথে সংঘাতে জড়িত শিশুর জন্য শিশু আদালত থাকবে। ভিকটিম শিশুর জন্য শিশু আদালত নয়। এমনকি ২০১৮ সনে সংশোধনীতে শিশু আইন, ২০১৩ এর ৫৪(১) ও ৫৪(৩ক) হতেও ‘বিচার প্রক্রিয়ায় সকল পর্যায়ে’ এবং ‘বিচার প্রক্রিয়ার সহিত সংশ্লিস্ট’ শব্দগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। সে কারনে ভিকটিম শিশুকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে শিশু আইন, ২০১৩ এর আগেই প্রনীত নারী ও শিশু আইন, ২০০০ নামের বিশেষ আইনের অধীনে ২২ ধারা করতে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা যাবে। তবে ফৌজদারী কার্যবিধির অধীনে ১৬৪ ধারা করতে শিশুকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করা যাবে না। কেননা সে অপরাধী নয় । জবানবন্দি ফরমে উল্লেখিত বিষয় বুঝার মতো ক্ষমতা তার মস্তিষ্কে নাই মর্মে বিশ্বের প্রায়ই সকল বিশেষজ্ঞ একমত। এমনকি গত ২৮/০৮/২০১৯ ইং তারিখে সর্বসম্মতভাবে মাননীয় বিচারপতি মো: শওকত হোসাইন, বিচারপতি মো: রুহুল কুদ্দুস এবং বিচারপতি এ.এস.এম আব্দুল মুবিন এর বৃহত্তর বেঞ্চ হতে আনিস মিয়া বনাব রাষ্ট্র মামলায় শিশুর ১৬৪ ধারার জবানবন্দির সাক্ষ্যগত মূল্য নেই এবং উক্ত জবানবন্দির ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করা যায়না মর্মে উল্লেখ করেছেন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১১ অনুযায়ী উক্ত আইন অধস্তন আদালতের জন্য অবশ্যই (shall) পালনীয় হবে।

শুধু তাই নয়, Bangladesh Legal Aid and Services Trust and another Vs Bangladesh and others, ২২ বিএলডি, পৃষ্ঠা ২০৬ মামলাতেও রিট এক্তিয়ারে শিশুর ১৬৪ ধারার জবানবন্দির ভিত্তিতে সাজা এক্তিয়ার বিহীন ঘোষণা করা হয়। উক্ত রায়ে বলা হয়, “The confession made by a child is of no legal effect” প্রায় একইভাবে Ali Fakir Vs State, ২৮ বিএলডি, পৃষ্ঠা ৬২৭ এ ১৪নং পারাগ্রাফ এ একইরূপ সিদ্ধান্ত হয়। আনিস মিয়া বনাম রাষ্ট্র মামলায় বলা হয়,“Similarly the Shishu Ain, 2013 in its definition clause [section 2 (3)] used the phrase ‘children in conflict with the law’ and prohibited the words ‘guilty’, ‘convicted’ and ‘sentenced’ to indicate any child in conflict with the law. On the other hand, section 164 read with section 364 of the CrPC speaks of confession of “accused” to be made before the Magistrate. In view of the discrepancies of the indicative words in the Children Act/Shishu Ain and the Code of Criminal Procedure, we find it difficult to accept that by virtue of section 18 of the Children Act or section 42 of the Shishu Ain, confession of a child under section 164 of the CrPC can be recorded and used against him.”
তাছাড়া শিশুর জবানবন্দির গ্রহণের জন্য শিশু আইন, ২০১৩ এর ৪৭(১)এ সুনির্দিষ্টবিশেষ বিধান আছে। তাতে আছে,“৪৭(১) শিশুর মাতা-পিতা বা তাহাদের উভয়ের অবর্তমানে তত্বাবধানকারী অভিভাবক বা কর্তৃপক্ষ অথবা আইনানুগ বা বৈধ অভিভাবক বা বর্ধিত পরিবারে সদস্য এবং প্রবেশন কর্মকর্তা বা সমাজকর্মীর উপস্থিতিতে শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা শিশুর জবানবন্দি গ্রহণ করিবেন।”
অনেকের মতে শিশু আইনের অধীনে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি নেয়ার মতে সুযোগ আছে। কিন্তু এটা আদৌ সঠিক নয়।১৬৪ ধারার জবানবন্দি ফৌজদারী কার্যবিধি অনুসারে তদন্ত পর্যায়ে নেওয়া হয়। কিন্তু এরূপ জবানবন্দি গ্রহণের ধারা শিশু আইন, ২০১৩ এর ‘গ্রেফতার, তদন্ত, বিকল্প পন্থা এবং জামিন’ শিরোনামে ৬ষ্ট অধ্যায়ে অন্তুর্ভুক্ত আছে। যে অধ্যায়ে ফৌজদারী কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে এই কথা নেই। শুধু তাই নয় উক্ত অধ্যায়ে ২০১৮ সনের সংশোধনের পরেও ম্যাজিস্ট্রেট কথাটি নেই। আবার শিশু আদালত ও উহার কার্যপ্রণালী শিরোনামে পঞ্চম অধ্যায়ে ৪২ ধারায় ফৌজদারী কার্যবিধির বিধানাবলীর প্রযোজ্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে। অর্থাৎ জবানবন্দি সংক্রান্তে শিশু আইন, ২০১৩ এর ধারা ৪৭ থাকায় এবং মাননীয় হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চের রায় অনুসারে শিশুর ১৬৪ জবানবন্দি হয় না।
কিন্তু মো: হৃদয় বনাম রাস্ট্র মামলায় মাননীয় হাইকোর্ট একটি জামিন আবেদনের শুনানীর পর গত ০১/০৮/২০১৯ইং তারিখে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের বৃহত্তর বেঞ্চের রায়ের অনেক আগে ৭টি নির্দেশনা প্রদান করেন। ২নং নির্দেশনায় বলা হয়,“ রিমান্ড সংক্রান্ত আদেশ শিশু আদালতেই হওয়া বাঞ্চনীয়। তবে আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু (ভিকটিম ও সাক্ষী ) বা আইনের সংগে সংঘাতে জড়িত শিশুর জবানবন্দি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট লিপিবদ্ধ করতে পারবেন।” কিন্তু উক্ত রায়টি একটি জামিন শুনানীর সময় প্রদান করা হয় এবং মহামান্য কোর্টের নিকট জবানবন্দি নেওয়ার প্রসঙ্গে শিশু আইনের ৪৭ ধারার সুনির্দিষ্ট বিধান আদালতে নজরে আনা হয়নি এবং উক্ত রায়ের মধ্যেও ৪৭ ধারা নিয়ে কোন মন্তব্য নেই। তাছাড়া উক্ত রায়ের পরে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের বৃহত্তর বেঞ্চের আনিছ মিয়া বনাম রাস্ট্র মামলার রায় প্রকাশিত হয়। অধিকন্তু উক্ত রায়ের ৬নং নির্দেশনা বলা হয়, “ আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি হল এই যে, আইন মন্দ (bad Law) বা কঠোর (harsh law) হলেও তা অনুসরণ করতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তা সংশোধন বা বাতিল না হয়।” এমনকি গত ১০ই মার্চ ২০২১ খ্রি. তারিখে মাননীয় রেজিস্ট্রার জেনারেল মো: আলী আকবর স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট হতে জানানো হয়, হাইকোর্ট বিভাগের ১৪৮১/২০২১ ফৌজদারী মামলায় মাননীয় বিচারপতি জনাব এ,কে এম, আব্দুল হাকিম ও মাননীয় বিচারপতি জনাব ফাতেমা নজীব মহোদয়ের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ গত ১৮/০২/২০২১ তারিখের আদেশে শিশু আইন, ২০১৩ ( সংশোধিত-২০১৮) এর বিধানাবলী প্রতিপালন সংক্রান্তে নিরূপণ নির্দেশনা প্রদান করেছেন, all the Shishu Adalat shall follow meticulously the provisions of Shishu Ain,2013 (as amended upto 2018) in dealing with the cases of juvenile offenders.
তাই উপরোক্ত আলোচনার আলোকে এটি পরিষ্কার যে, মূল্যহীন অনর্থক শিশুর ১৬৪ ধারা জবানবন্দি নেওয়া উচিত নয়। আর সব সময় মাননীয় শিশু আদালত জামিন ও কাস্টডি দিবেন। এ প্রসঙ্গে ১৩/০৬/২০২১ ইং তারিখে মাননীয় বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া এবং বিচারপতি কামরুল হোসেন মোল্লা সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ ৭দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। তবে এখনো সরল বিশ্বাসে অনেক ম্যাজিস্ট্রেট শিশুদের কাস্টডি দিচ্ছেন। সময়ের প্রেক্ষাপটে ধীরে ধীরে ম্যাজিস্ট্রেটদের উক্ত ভুল সংশোধন হবে এবং মানুষ ন্যায় বিচার পাবে আশা করা যায়।

সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে গার্ড অব অনারে নারীর বিকল্প

 বীরমুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প খুজার ভাবনা; সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে কি বলে আজকে সেটাই আলোচ্য বিষয়।।

কবি বলেছেন, বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছি নারী, অর্ধেক তার নর।
সরকারের নীতি মালা অনুযায়ী, কোনো বীরমুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার পর তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানায় সংশ্লিষ্ট জেলা/উপজেলা প্রশাসন। ডিসিবাইউএনও সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে থাকেন। কফিনে সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী কর্মকর্তা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

অনেক স্থানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে নারী কর্মকর্তারা রয়েছেন, আর সেখানেই আপত্তি তুলেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

গত ১৩ জুন, রোববার সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা ওঠার পর সরকারের কাছে সুপারিশ রাখা হয়েছে গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প খুঁজতে।

সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “বীরমুক্তিযোদ্ধাদের ‘গার্ড অব অনার’ প্রদানের ক্ষেত্রে দিনের বেলায় আয়োজন করা এবং মহিলা ইউএনওর বিকল্প ব্যক্তি নির্ধারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।”(তথ্যসূত্র :বিডিনিউজ২৪.কম)
চারদিক থেকে যখন আমরা নারীদের এগিয়ে যাওয়ার খবর শুনি ঠিক এইসময়ে এইরকম একটি দুঃখজনক খবর আমাদের সত্যিই ব্যথিত করে। এটি একাধারে যেমন চরম নারীবিদ্বেষী তেমনি বৈষম্যমূলক আবার রাষ্ট্রের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে আমরা দেখব, যে চারটি মূলনীতির কথা বলা হয়েছিলো তারমধ্যে একটি হলো গণতন্ত্র। একটি রাষ্ট্রের অর্ধেক জনগণের প্রতি বৈষম্য করে কিভাবে একটি রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়? সেটা খুব সহজেই অনুমান করা যায়। যদি আপনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান তাহলে অবশ্যই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিককে সমান অধিকার চর্চার সুযোগ দিতে হবে। সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে কিছু লাইনআমি হুবহু তুলে ধরছি।

লাইনগুলো নিম্নরুপ:
আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকসাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে। এখানে, উল্লিখিত অধিকার গুলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প খুজার কথা বলার অর্থ হলো আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার ধারণাকে অস্বীকার করা। নারীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে কিভাবে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়? শুধু তাই নয়, একইসাথে আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, সামাজিকসাম্য এবং সুবিচার এই বিষয়গুলোর সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প খুজার ভাবনাটি।
আসা যাক,সংবিধানের ১৯(৩) অনুচ্ছেদে, যেখানে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে,
জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প খুজার ভাবনাটি ১৯(৩) অনুচ্ছেদের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকলসময়েজনগণেরসেবাকরিবারচেষ্টাকরাপ্রজাতন্ত্রেরকর্মেনিযুক্তপ্রত্যেকব্যক্তিরকর্তব্য৷আমরাএইঅনুচ্ছেদথেকেবলতেপারিগাগার্ড অব অনারে নারীদের অংশগ্রহন করতে না দেওয়ার মানে হলো তাকে তার কর্তব্য পালনে বাধা দেওয়া।
অনুচ্ছেদ ২৭-এ বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। কিন্ত, এখানে আমরা এই অনুচ্ছেদের প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছিনা। একইসাথে,অনুচ্ছেদ ২৮-এ উল্লিখিত ধর্ম, প্রভৃতি কারণে বৈষম্য না করার নীতিটির সাথেও সাংঘর্ষিক আমাদের এই মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প খুজার ভাবনাটি। একই সাথে, রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারীপুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন। [অনুচ্ছেদ ২৮ (২)]
অনুচ্ছেদ ২৯ (১) এ বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ – লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। সুতরাং, এই বিধানটির মারাত্মক অবমাননা হয়েছে
মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প খুজার ভাবনাটির মাধ্যমে।
শুধু তাই না,আমাদের সংবিধান যেখানে নারীদের এগিয়ে আনার জন্য Positive Discrimination নীতির এবং নারী নেতৃত্ব কে সামনে আনার জন্য নারীদের জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করেছে সেইখানে যদি নারীর প্রাপ্য অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয় তখন আমাদেরকে অবশ্যই এই সিদ্ধান্তকে একটি নারীবিদ্বেষী সিদ্ধান্ত বলতে হবে।
Mosammat Nasrin Akhter and others vs. Bangladesh and others [‘Gender Discrimination in Public Employment’ Case] এটি একটি লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ মামলা।
নিচে কিছু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিল দেখাচ্ছি যেগুলো নারীর অধিকারকে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছে।

Universal Declaration of Human Rights.

International Covenant on Economic, Social and Cultural Rights.(অনুচ্ছেদ ২, ৩ এবং ৭)

International Covenant on Civil and Political Rights.( অনুচ্ছেদ ২, ৩ এবং ২৬).

European Social Charter.( অনুচ্ছেদ ৪ এবং ৮)

European Social Charter (revised)[ অনুচ্ছেদ ৪ (৩), ৮ এবং ২৭]

Inter-American Convention on the Prevention, Punishment and Eradication of Violence Against Women.

Inter-American Convention on the Nationality of Women.

Inter-American Convention on the Granting of Civil Rights to Women.

African Charter on Democracy, Elections and Governance.( অনুচ্ছেদ ৮ (২),২৯ এবং ৪৩)

African Charter on Human and Peoples’ Rights [অনুচ্ছেদ ১৮ (৩)]

African Charter on the Rights and Welfare of the Child (অনুচ্ছেদ ১৪)

American Convention on Human Rights [অনুচ্ছেদ ১ (১), ৬ (১) এবং ২৭ (১)]

American Declaration of the Rights and Duties of Man (অনুচ্ছেদ ২ ও ৭)

Arab Charter on Human Rights (অনুচ্ছেদ ৩, ৪, ১০, ৩৩, ৩৪, ৪৩)

Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women.

Convention on the Nationality of Married Women.

Convention on the Political Rights of Women.

Convention for the Suppression of the Traffic in Persons and of the Exploitation of the Prostitution of Others.

Council of Europe Convention on Preventing and Combating Violence against Women and Domestic Violence.(ইস্তানবুল কনভেনশন)

European Convention for the Protection of Human Rights and Fundamental Freedoms.

পরিশেষে বলতে চাই, একটি জাতির অর্ধেক জাতিকে পিছনে ঠেলে দিয়ে, অবহেলা করে,তাদের অধিকারকে অস্বীকার করে কখনো একটি জাতি এগিয়ে যেতে পারেনা। দেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীইউএনওদের বিকল্প খুজার প্রস্তাবটি কোনভাবেই যেন কার্যকর করা না হয় তার জোর দাবি জানাচ্ছি।

পুলিশের সাক্ষ্য গ্রহণ ও তল্লাশীর ক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মৌলিক মানবাধিকার স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে আছে, “(১) সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। (২) সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।” সে প্রক্ষাপটে রাষ্ট্রে কোন অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশ সঠিকভাবে সেবার মানসিকতা নিয়ে সংবিধান ও আইন মান্য করে তদন্ত করবে এটাই সবাই  আসা করে। ফৌজদারী অপরাধ সংঘটিত হলে  মামলা রুজু হওয়ার পর তদন্ত শুরু হয়। আর তদন্তের সফলতা অর্জনের মাফকাঠিতে পুলিশ অফিসারের যোগ্যতা পরিমাপ করা হয়। তদন্ত শুরু হওয়ার পূর্বে এবং ঘটনাস্থলে রওনা হওয়ার পূর্বে তদন্তকারী অফিসার ভিলেজ ক্রাইম নোট বুক ও অন্যান্য রেজিস্ট্রার দেখে থাকেন। (পিআরবির ২৫৬ নং রেগুলেশন) ।

তদন্তকালীন সময়ে হাজির হতে পুলিশ যে কাউকে বাধ্য করতে পারেন। কিন্তুু সংশ্লিষ্ট পক্ষ এবং সাধারণ লোকদের অযথা হয়রানী হতে তদন্তকারী অফিসারকে বিরত থাকতে হয়। তদন্তে যাদের সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কেবল তাদেরকে ডাকতে হবে। সম্ভব হলে তদন্তকারী অফিসার সাক্ষীদের বাড়ী যাবে। তদন্তকালীন সময়ে পুলিশ কেইস ডায়েরী সংরক্ষণ করবেন। থানায় খবরটি কবে পোঁছাল, কোন সময় তিনি তদন্ত আরম্ভ এবং শেষ করেছেন, কোন কোন স্থান পরিদর্শন করেছেন এবং তদন্তের ফলে যে পরিস্থিতি তিনি দেখতে পেয়েছেন তার একটি বিবরণ লিপিবদ্ধ করবেন। এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যান, পৌরসভার কাউন্সিলর কোন সাহায্য করলে তা লিপিবদ্ধ করবেন। (পিআরবির ২৬৩ এবং ২৬৪ নং রেগুলেশন)

কেউ হাজির না হলে পুলিশ আদালতে জানাতে পারেন। কেননা পিআরবি এর ২১এ নং  বিধিতে আছে, ’21 (a) Except as provided in the Code of Criminal Procedure or any other Act, or in any rules made or approved by the Provincial Government, for the time being in force, subordinate Magistrates have no power to interfere in police work. But Magistrates having jurisdiction and empowered to take cognizance of police cases are reminded of their responsibility for watching the course of police investigations in the manner laid down in Chapter XIV of the Code of Criminal Procedure.’

তদন্তকালীন সময়ে কেউ পুলিশের তদন্ত কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। পুলিশ যে ব্যক্তি ঘটনা সম্পর্কে জানেন তাকে মৌখিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। সে ব্যক্তি পুলিশকে সকল প্রশ্নোত্তর দিতে বাধ্য। ফৌজদারী  কার্যবিধির ১৬১(২) আছে, ‘Such  person shall  be bound  to answer all questions relating to such case put to him by such officer, other than questions the answer to which would have a tendency to expose him to a criminal charge or to a penalty or forfeiture.’ তবে যে প্রশ্ন তাকে ফৌজদারী অভিযোগ, দন্ড এবং বাজেয়াপ্তির দিকে নিয়ে যায় সে সকল প্রশ্ন উত্তর দিতে সে বাধ্য নয়। তদন্তকারী পুলিশ উক্ত জবানবন্দি লিখে নিতে পারেন। তবে লিখিত হলে বিবৃতিদাতা তাতে অবশ্যই স্বাক্ষর করবেন না। কিছু শর্ত ব্যতিত এরুপ বিবৃতি বা রেকর্ড অনুসন্ধান বা বিচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। তবে এরুপ কোন সাক্ষীকে অনুসন্ধান বা বিচারে রাস্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসাবে তলব করা হলে আসামীর অনুরোধক্রমে আদালত তা উক্ত লিখিত বিবৃতি উল্লেখ করবেন এবং আসামীকে একটি কপি বা নকল প্রদানের নির্দেশ দিবেন। এখানে বিচারের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইনের ১৪৫ ধারা প্রাসঙ্গিক হবে। উক্ত ধারা অনুসারে একজন সাক্ষীকে তার পূর্ববর্তী লিখিত এবং প্রাসঙ্গিক বিবৃতির জন্য জেরা করা যায়। আর এরুপ ক্ষেত্রে কোন বিবৃতি ব্যবহার করা হলে উক্ত সাক্ষীকে পুন:পরীক্ষার ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে কেবল মাত্র তার জেরায় উল্লেখিত কোন ব্যাখ্যার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। আর এরুপ বিবৃতি অনুসন্ধান বা বিচারের বিষয় বস্তুুর সাথে প্রাসঙ্গিক না হলে অথবা ন্যায় বিচারের স্বার্থে তা আসামীর নিকট প্রকাশ করা অতি আবশ্যক না হলে এবং জনস্বার্থে যুক্তিযুক্ত না হলে আদালত তাঁর মতামত লিপিবদ্ধ করবেন এবং আসামীকে প্রদত্ত বিবৃতির নকল হতে উক্ত অংশ বাদ দিবেন। তবে সাক্ষ্য আইনের ধারা ৩২(১) অনুসারে কোন ব্যক্তি তার মৃত্যুর কারন সম্পর্কে বা প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কোন বিবৃতি প্রদান করলে তা প্রাসঙ্গিক হবে। এমনকি সাক্ষ্য আইনের ধারা ২৭ অনুসারে পুলিশ হাজতে থাকা কোন আসামীর কথামত কোন বস্তুু বা তথ্য উদ্ধার হলে সে তথ্য দোষস্বীকারের ভিত্তিতে হোক না হোক অপরাধ প্রমানের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হবে। (ধারা-১৬১, ১৬২) ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ১৬২(৩) আছে, ‘(2) Nothing in this section shall be deemed to apply to any statement failing within the provisions of section 32, clause (1) , of the Evidence Act, 1872 [or to affect the provisions of section 27 of the Act.’

সাক্ষ্য আইনের ২৭ ধারায় আছে, ‘Provided that, when any fact is deposed to as discovered in consequence of information received from a person accused of any offence, in the custody of a police officer,  so much of such information, whether it amounts to a confession or not, as relates distinctly to the fact thereby discovered,  may be proved.”

পুলিশ অফিসার কিংবা অন্য কেউ আসামীকে কোন প্রলোভন, হুমকি বা প্রতিশ্রæতি দিয়ে জবানবন্দি নিবেন না। এরুপ দোষ স্বীকারোক্তি উক্ত আসামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য আইনের ২৪ ধারা অনুসারে আদালতের নিকট গ্রহনযোগ্য হয় না। তবে স্বেচ্ছায় আসামী তদন্তকালীন সময়ের বিবৃতি দিতে চাইলে কেউ তাকে প্রতিহত করবে না। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৩(২) ধারায় আছে, ‘(2) But no police-officer or other person shall prevent, by any caution or otherwise, any person from making in the course of any investigation under this Chapter any statement which he may be disposed to make of his own free will.’ আর আসামী চাইলেই স্বেচ্ছায় বিনা প্ররোচনায় বিনা আঘাতে এবং বিনা প্রলোভনে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে পারেন। উক্ত জবানবন্দি তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে এটাও আসামীকে জানতে হয়। আর চিন্তাভাবনার জন্য আসামীকে সে সময় ৩ ঘন্টা সময় দিতে হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ৩৬৪ ধারার বিধান ও ফরম মোতাবেক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করবেন।

তদন্তকারী অফিসার তদন্ত ও অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন কিছু কারন লিপিবদ্ধ করে কোন প্রকার দেরী ব্যতিত কোন স্থানে তল্লাশী করতে পারেন। তবে ব্যাংকার্স বুক্স এভিডে›স এ্যাক্ট, ১৮৯৮ অনুসারে কিছু ব্যতিক্রম আছে। তিনি অসমর্থ হলে তার অধীনস্ত কোন অফিসারকে লিখিত কারণ উল্লেখপূর্বক তল্লাশী স্থান বা তল্লাশীর বিষয়ে উল্লেখ পূর্বক তল্লাশীর জন্য বলতে পারেন। তবে মহিলাদের তল্লাশীর ক্ষেত্রে অন্য একজন মহিলা দিয়ে অবশ্যই তল্লাশী করতে হবে। (ধারা-৫২) আর তল্লাশীর ক্ষেত্রে পুলিশ ফৌজদারী কার্যবিধির ১০২ এবং ১০৩ অনুসারে ব্যবস্থা নিবেন। সেক্ষেত্রে তল্লাশী করার পূর্বে পুলিশ দুই বা তার অধিক সংশ্লিষ্ট এলাকার সাক্ষী উপস্থিত রাখবেন এবং যে সমস্ত দ্রব্যাদি পাবেন তার তালিকা করে তাদের স্বাক্ষর নেবেন এবং উক্ত তালিকা যার দখলীয় স্থান বা যার নিকট হতে পাওয়া যাবে তার অনুরোধে তার নিকট অবশ্যই একটি কপি প্রদান করতে হবে। আটককৃত মালের ৩(তিন) কপি তালিকা প্রণয়ন করতে হয়। এক কপি তদন্তকারী কর্মকর্তা, আরেক কপি যার বাড়ী হতে উদ্ধার করা হয়েছে তাকে বা তার প্রতিনিধিকে এবং অন্য কপি কোর্ট ইন্সপেক্টর এর মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর উপস্থাপন করতে হয়। সার্চ ওয়ারেন্ট সহ বা ওয়ারেন্ট ব্যতিত তল্লাশী হয়। ওয়ারেন্ট যিনি কার্যকর করবেন তাকে সম্পূর্ণরুপে সকল সন্দেহের উর্ধ্বে থাকতে হবে। যুক্তিসঙ্গতভাবে সন্দেহ হলে পুলিশ অফিসার তার ডায়েরীতে উল্লেখ পূর্বক তল্লাশী পরিচালনা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে ওয়ারেন্টের দরকার হয় না।

তদন্তকারী কর্মকর্তা এক থানা হতে অন্য থানায় তল্লাশীর জন্য রিকুইজিশান দিতে পারেন। রিকুইজিশন অনুমোদনে দেরী হচ্ছে মনে হলে সরাসরি তল্লাশী করা যাবে। সেক্ষেত্রে একটি নোটিশ ঐ থানার অফিসার ইনচার্জকে দিবেন এবং একই সংগে জব্দতালিকার একটি কপি ঐ এলাকার অফিসার ইনচার্জ ও ম্যাজিস্ট্রেটকে পাঠাতে বাধ্য থাকবেন। কোন ব্যক্তি উক্ত তল্লাশীতে হাজির না হলে বা সাক্ষী না থাকলে সে দন্ডবিধির ১৮৭ ধারা আইন অনুসারে কোন সরকারী কর্মকর্তাকে সহযোগিতা না করার অপরাধে অপরাধী হবেন। আর সকল ক্ষেত্রে তল্লাশীর জব্দতালিকার একটি কপি যে ম্যাজিস্ট্রেট আমল গ্রহণ করেন তার নিকট একটি কপি অবশ্যই পাঠাতে হবে। পুলিশ না দিলে উক্ত কপি তল্লাশীকৃত স্থানের মালিক বা দখলকার আবেদন করলে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে মূল্য দিয়ে বা মূল্য ছাড়া সরবরাহ করতে পারেন।

আর তদন্তের প্রয়োজনে আমলযোগ্য মামলায় পুলিশ যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে আগে সাক্ষ্য সংগ্রহ পরে ১৬৭ (১) অনুসারে গ্রেফতার করতে হয়। বিনা কারনে কাউকে গ্রেফতার উচিত নয়। এজন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা মাজিস্ট্রেটের নিকট জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে পারেন।

আর এভাবেই উপরোক্ত প্রক্রিয়া অবলম্বন করে পুলিশ ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭৩ ধারা অনুসারে, পক্ষদের নাম, তথ্যের ধরন, সাক্ষীদের নাম ও সাক্ষ্য, আসামীদের নাম, মালামাল সহ পিআরবি অনুসারে ঘটনাস্থলের স্ক্যাচম্যাপ, খসড়ামানচিত্র সূচী এবং অন্যান্য সাক্ষ্য সহ কার বিরুদ্ধে কি অপরাধ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখপূর্বক আদালতে রিপোর্ট প্রদান করবেন যাতে ম্যাজিস্ট্রেট ধারা ১৯০(১) অনুসারে মামলা আমলে নিতে পারেন। পুলিশ একই সাথে বাদীকেও মামলার ফলাফল জানাবেন। তবে রিপোর্ট দেয়ার পরও থানার অফিসার ইনচার্জ অতিরিক্ত সাক্ষ্য পেলে (মৌখিক বা দালিলিক) একটি অধিকতর রিপোর্ট প্রদান করতে পারবেন কিন্তুু তাও বাদীকে জানাবেন। আর আসামী দরখাস্তের ভিত্তিতে এ রিপোর্টের একটি কপি পেতে হকদার হয়।

পুলিশ যথাযথ তদন্ত করলে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭(১) ধারা অনুসারে ২৪ ঘন্টায় শেষ করতে না পারলে পিআরবির ২৬১(সি) এর প্রবিধান অনুসারে সর্বোচ্চ ১৫ পনের দিনের মধ্যে পুলিশ তদন্তÍ শেষ করতে পারে। পুলিশ সাক্ষ্য গ্রহণে ও তল্লাশি সংক্রান্তে তার ক্ষমতাও সীমাবদ্ধতা জেনে তদন্ত করলে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(৩) অনুসারে দ্রæত তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে।

আওয়ামী লীগের জন্ম-কথা ও বঙ্গবন্ধু

 ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন, আওয়ামী লীগের যেদিন জন্ম শেখ মুজিব সেদিন জেলে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিন্ম বেতনভোগী কর্মচারীরা তাদের দাবী জানিয়ে এক মাসের নোটিশ দিয়ে ১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ থেকে ধর্মঘট শুরু করে। শেখ মুজিবসহ ছাত্ররা এ আন্দোলনে যোগ দেয়। ফলে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল ২৭ ছাত্রকে বহিস্কারসহ জরিমানা করে। শেখ মুজিবের জরিমানা ১৫ রুপি। প্রায় অর্ধেক ছাত্র মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরে পেলেও শেখ মুজিব তাতে রাজী হননি। তার বক্তব্য, ‘আমি কোন অন্যায় দাবী করি নাই, অত্যন্ত ন্যায়সংগত দাবি করেছি। মুচলেকা ও জরিমানা দেওয়ার অর্থ হলো দোষ স্বীকার করে নেওয়া, আমি তা করব না।’ শেখ মুজিব তখন আইন বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র।

ধর্মঘটের কারনে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রেখে ১৭ এপ্রিল খুলে দিলে শুরু হয় আবার ধর্মঘট। ১৮ তারিখ ধর্মঘট শেষে শোভাযাত্রা করে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাহাউদ্দিন চৌধুরী, নাদিরা বেগম, আবদুল ওয়াদুদ এবং শামসুল হুদাসহ ঢাকা মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ শতাধিক ছাত্র ২ ঘটিকায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা প্রদক্ষিণ করে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে জমায়েত হন এবং কিছু ছাত্র বাড়ির দেওয়াল এর ভিতরে প্রবেশ করে শ্লোগান দিতে থাকেন। সন্ধা ৬ ঘটিকায় ছাত্ররা উপাচার্য ভবনের ভিতরে কাউন্সিল হলে সভা করেন। তাতে শেখ মুজিব ঘোষনা করেন, ‘আমরা এখানেই থাকব, যতক্ষন শাস্তিমুলক আদেশ প্রত্যাহার করা না হয়।’ একশ’জন করে ছাত্র রাত দিন উপাচার্যের বাড়িতে বসে থাকার সিদ্ধান্ত হয়। একদল ছাত্র যায়, আর একদল থাকে। ব্যতিক্রম শুধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি জায়গা ছাড়লেন না।

খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসেন এবং ছাত্রদের দাবীর কথা শুনে ৬.৩০ মিনিটে উপাচার্যের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করেন। ছাত্ররা তখন সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কাউন্সিল সদস্যরা উপাচার্যের সাথে আলোচনা করে নিচে এসে আন্দোলন বন্ধ করে ছাত্রদের বাড়ি চলে যেতে বলেন। কিন্তু ছাত্রদের উপর আরোপিত শাস্তি প্রত্যাহারের কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। ছাত্ররা তখন কমিটির সদস্যদের সামনে শুয়ে তাদের বের হয়ে যাওয়ার পথে বাধা দেন ও বিষয়টি নিস্পত্তির আবেদন করেন। ছাত্রদের এমন দাবীর মুখে পরের দিন সকাল পর্যন্ত আলোচনা চালিয়েও পক্ষগনের মধ্যে কোন সমাধান হয়নি। তখনও কমবেশি ২৫ ছাত্র উপাচার্যের বাড়িতে অবস্থান করতে থাকেন।

১৯ মার্চ বিকাল ৩ ঘটিকায় ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপার একদল পুলিশ বাহিনী নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনে হাজির হলেন। এসেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পাঁচ মিনিট সময় দিলেন ছাত্রদের স্থান ত্যাগ করতে। শেখ মুজিব তখন ৮ জন ছাত্রকে বললেন থাকতে আর বাকীদের বাসভবন ছেড়ে যেতে বললেন। তিনিসহ ৮ জন ছাত্র জায়গা ছাড়বেন না বলে জানান। পাঁচ মিনিট পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৫৪ ধারায় শেখ মুজিবুর রহমান, সিরাজুল হক, এ এইচ এম আবদুস সাত্তার, আতাউর রহমান, এ এইচ এম শামসুল হুদা, মোজহারুদ্দিন আহমেদ ও আবু নাসের মোহাম্মদ ওয়াহেদকে গ্রেফতার করেন।

উপাচার্যের বাসভবন হতে গ্রেফতারের পর শেখ মুজিবুর রহমানকে বেশিদিন আটকে রাখা সম্ভব হবে না জেনে ২৯ এপ্রিল বেঙ্গল স্পেশাল পাওয়ার অর্ডিন্যান্স ১৯৪৯ এর ১৮(২) ধারামতে গ্রেফতার দেখিয়ে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেওয়া হয়। এ আটকাদেশ বহাল থাকার মধ্যেই ২৫ মে সরকারী আদেশে তার মেয়াদ বাড়ানো হয়।

জননিরাপত্তা আইনে শেখ মুজিবের আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করে অ্যাডভোকেট এম এ খোন্দকার ঢাকা হাইকোর্টে ২০ ও ২৩ জুন ২টি হেবিয়াস কর্পাস মামলার আবেদন করেন। বিচারপতি মি. এলিস ও বিচারপতি মি. আমীরুদ্দিন আহমদের সমন্ময়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে প্রাথমিক শুনানী শেষে সরকারের উপর মামলার নোটিশ জারী করা হলে তারা সময়ের করেন। সরকারের আবেদনে ১ জুলাই পর্যন্ত মামলার শুনানী মুলতবী করা হয়।

হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস মামলা শুনানীর জন্য অপেক্ষমান থাকাবস্থায় পুর্ব পাকিস্তান সরকার এক আদেশ দ্বারা শেখ মুজিবের আটকাদেশ বাতিল করেন। পরে ২৬ জুন শর্তহীনভাবে শেখ মুজিব ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগার হতে মুক্তি পান।

শেখ মুজিবের মুক্তির তিন দিন আগে ২৩ জুন বেলা ৩ ঘটিকায় কাজী হুমায়ুন বশীর এর বাসভবন ঢাকার কে এম দাস লেনের ‘রোজ গার্ডেন’ এর দোতলার হলঘরে এক রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলন অনুষ্টিত হয়। এ কর্মী সম্মেলনেই ‘পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠন করা হয়। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানিকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সাধারন সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হন। দুজনেরই বাড়ি টাঙ্গাইল। মাওলানা ভাসানী এর আগে ভারতের আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। কৃষকের অধিকার নিয়ে আন্দোলনের কারনে কৃষকনেতা হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। আসামের ‘ভাসানী’ এলাকায় বসবাসের জন্য তার নামের শেষে এ উপাধি যোগ হয়।

এ সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানকে সংগঠনের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মনোনীত করা হয়। শেখ মুজিব জননিরাপত্তা আইনে আটক থাকায় খবরের কাগজে তার নামের পাশে ‘নিরাপত্তা বন্দি’ লিখা হয়। অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান খান, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খান ওরফে বাদশা মিয়া, অ্যাডভোকেট আলী আমজাদ খান, আনোয়ারা খাতুন এম.এল.এ, খয়রাত হোসেন এম.এল.এ, ইয়ার মোহাম্মদ খান, আলমাস খান ও আবদুল আওয়াল আজিজ আহমেদকে সদস্য করা হয়।

‘আওয়ামী লীগ’ নামটি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর দেওয়া। কারাগারে বসে দলের নাম শোনার পর শেখ মুজিবের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া ছিল- ‘পাকিস্তান হয়ে গেছে, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা শুধু ম্যানিফেষ্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনো আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন তারা চিন্তাভাবনা করেই করেছেন।’ পরে অবশ্য মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ২১-২৩ অক্টোবর ১৯৫৩ সালের অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়।

১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে কারাগারে যাওয়ার পরপরই শেখ মুজিবের ছাত্র রাজনীতির অবসান ঘটে। জেল থেকে বের হয়ে সেপ্টেম্বরে পুর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল সভায় ঢাকার তাজমহল সিনেমা হলে শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। সম্মেলনে দবিরুল ইসলাম ও খালেক নেওয়াজ খানকে সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক করে ছাত্রলীগের নতুন কেন্দ্রিয় কমিটি গঠন করা হয়। এটাই ছিল ছাত্রলীগের সঙ্গে শেখ মুজিবের শেষ আনুষ্ঠানিক বৈঠক। সভাপতির ভাষনে তিনি ঘোষনা দেন, যেহেতু তিনি আর ছাত্র নন, তাই এ প্রতিষ্ঠান আর সদস্য হিসেবে থাকবেন না।

প্রযুক্তিগত বোকামি ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত

  ইন্টারনেট ১৯৬৯ সালে আবিস্কৃত হয়। গত ১৯৯৫ সালে ইন্টারনেট বাণিজ্যিক বা কর্পোরেট পন্য হিসেবে আবির্ভূত হয়ে চলমান রয়েছে। গত ১৯৯০ দশকে টেলিফো...