Tuesday 15 June 2021

‘’বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’’– আইন কি বলে?

 শুরুতে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষনের বিষয়টি ভাল করে বুঝার জন্য চলুন আমরা আমাদের কল্পনার জগতটাকে একটু প্রশস্ত করি…

 

রিসার্চ প্যানেল:

ঘটনা :
ধরা যাক, লাইলির সাথে মঞ্জুর বহুদিনের নিবিড় প্রেমের সম্পর্ক। তাদের এই সম্পর্ক চূড়ান্ত পরিণয়ের দিকে না গিয়ে হঠাৎ একদিন ভিন্ন পথে মোড় নিল। বিচ্ছেদ হল তাদের। এই বিচ্ছেদের বিপরীতে ক্ষুব্দ লাইলি মঞ্জুকে দেখে নেয়ার হুমকি দিল। তদানুযায়ী, লাইলি তার নিকটস্থ থানায় মঞ্জুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ঠুকে দিল। ধর্ষণের অভিযোগটি এই মর্মে দায়ের করা হল যে— প্রেমিক মঞ্জু বিশ্বাস ভেঙ্গেছে লাইলির, বিয়ের প্রলোভনে করেছে ধর্ষণ! বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগটি দায়ের করা হল— নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯(১) ধারায়।

আলোচনার বিষয়বস্তু :
লাইলি ও মঞ্জুর মধ্যকার বিরাজমান বিরোধের আইনগত নানান দিক নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা। মনে রাখতে হবে, বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বিষয়টি এখনো আমাদের দেশীয় আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা নেই। এমনকি এই সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো আইনও নেই। সুতরাং, এই বিষয়টি সম্পর্কে সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট কোনো বিধিবিধান আপাতত নেই। পূর্বে গুটিকয়েক এ সংক্রান্ত অভিযোগ থানা বা আদালতে দায়ের করা হলেও, অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে উচ্চ আদালতকে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া লাগতে পারে। অথবা, বৃহত্তর স্বার্থে আইনও সংশোধন করা লাগতে পারে। তবে, ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে দায়েরকৃত বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের গুটিকয়েক মামলায় উচ্চ আদালত ইতোমধ্যে কয়েকটি সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন যার মাধ্যইে মূলত এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে হবে, যেহেতু এসংক্রান্ত সুস্পষ্ট কোনো বিধান এখনোবধি নেই। প্রক্ষান্তরে, যেহেতু এই বিষয়টি একটি বৈশ্বিক আলোচিত বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে, তাই আমরা দেখব দেশের বাইরের আদালতগুলো এসম্পর্কে কি বলে।

আইনি আলোচনা :
বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যেতে হলে আমাদের শুরুতেই দেখতে হবে ধর্ষণের সংজ্ঞা। কারণ, এখানে ধর্ষণকে প্রধান অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, এবং ধর্ষণের ক্ষেত্রে অভিযোগকারীনির সম্মতি আদায় করা হয়েছে বিয়ের প্রলোভনে। অর্থাৎ, বিয়ের প্রলোভন এখানে সম্মতি আদায়ের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।

ধর্ষণের সংজ্ঞা :
দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় ‘ধর্ষণ’কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী পাঁচটি অবস্থায় যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ধর্ষণ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে –

১। নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ;

২। নারীর সম্মতি ছাড়া ;

৩। মৃত্যু কিংবা জখমের ভয় দেখিয়ে নারীর সম্মতি নিয়ে ;

৪। নারীর সম্মতি নিয়েই, কিন্তু পুরুষটি জানে যে সে ঐ নারীর স্বামী নয় এবং ঐ নারীটি তাকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করেছে যে পুরুষটির সাথে তার আইনসঙ্গতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে সে বিশ্বাস করে ;

৫। নারীর সম্মতিসহ বা সম্মতিছাড়া যদি সে-নারীর বয়স ১৪ বছরের কম হয়।

এখন, বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বিষয়টি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিয়ের প্রলোভনে নারীর সম্মতি আদায় করেছে যা ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের শর্তের অন্তভুক্ত না। ফলত, ৩৭৫ ধারায় প্রদত্ত সংজ্ঞার সরল বিশ্লেষণে স্পষ্টত যে, বিয়ের প্রলোভনে যৌন সম্পর্ক স্থাপন ধর্ষণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হবে না।

অন্যদিকে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ২(ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, “ধর্ষণ” অর্থ ধারা ৯ এর বিধান সাপেক্ষে, Penal Code, ১৮৬০ (Act XLV of ১৮৬০) এর Section ৩৭৫ এ সংজ্ঞায়িত “rape”;

অর্থাৎ, দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় প্রদত্ত ধর্ষণের সংজ্ঞা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ :
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে,

যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।

ব্যাখ্যা— যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ছাড়া ষোল বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করে তা হলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবে।

এই ধারাও সম্মতি নিয়ে দৈহিক সম্পর্ক হলে তা অপরাধ হিসেবে গন্য হবে না তবে বয়স হতে হবে ষোলো বছরের বেশি। তবে ব্যাখ্যা অংশের একটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য, বলা হয়েছে— প্রতারণামূলকভাবে যদি সম্মতি আদায় করা হয়। বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ মূলত এই বিধানের বিপরীতে দায়ের করা হয়।

লক্ষ্য করার বিষয়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯(১) ধারার ব্যাখ্যা অংশে বলা হয়েছে, প্রতারণার মাধ্যমে যদি ষোল বছরের অধিক কোনো নারীর সম্মতি আদায় করে যৌন সংঙ্গম করা হয় তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। কিন্তু, আইনটির ২ ধারার সংজ্ঞায় ক-ঠ পর্যন্ত বা অন্য ধারাগুলোতেও প্রতারণার কোনো সংজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। মূলত, আইনের এই দুর্বলতার কারণে আইনটির অপপ্রয়োগের সুযোগ যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি অনেকে আবার ন্যায় বিচার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।

তবে এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন মনে আসতেই পারে যে, বিয়ের প্রলোভনে সম্মতি আদায় কোনো বৈধ চুক্তি হতে পারে কিনা? সেক্ষেত্রে ধর্ষণ না হয়ে চুক্তিভংঙ্গের মামলা দায়েরের কোনো সুযোগ রয়েছে কিনা? আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে আপাতত না। কারণ, মুসলিম শরীয়াহ আইনের বিধানানুযায়ী, ভবিষ্যতে বিবাহের প্রতিশ্রুতি সংক্রান্ত কোনো মৌখিক চুক্তি অনুমোদিত না। উপরন্তু, বিবাহের চুক্তি সর্বদা লিখিত ও নিবন্ধিত হতে হবে। তথাপি, চুক্তি আইন ১৮৭২ এর ২(জ) ধারানুযায়ী, যেকোনো সম্মতি বা কোনো বিষয়ে কথা দিলেই তা চুক্তিতে রূপান্তর হয় না যতক্ষণ না পর্যন্ত সম্মতিটি আইন দ্বারা বলবৎযোগ্য হয়।

প্রক্ষান্তরে, বিয়ের প্রলোভনে সম্মতি আদায় প্রতারণা হতে পারে কিনা? যদি হয়, তবে সেক্ষেত্রে আইনে এটার আলাদা ব্যাখ্যা এবং আলাদা শাস্তির বিধান থাকা উচিত।

অন্যদিকে, দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৪৯৩ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নারীকে প্রতারণামূলকভাবে আইনসম্মত বিবাহিত বলে বিশ্বাস করান, কিন্তু আদৌ ওই বিয়ে আইনসম্মতভাবে না হয় এবং ওই নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, তবে অপরাধী সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।

এই ধারাটি মূলত বিয়ে বলবৎ আছে বিশ্বাস করিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অতএব, এই ধারায় বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বা ভবিষ্যতে বিয়ে করার আশ্বাস দিয়ে দৈহিক সম্পর্ক করলে তা অপরাধ হবে না।

 

উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তসমূহ :
হানিফ শেখ বনাম আছিয়া বেগম [৫১ ডিএলআর, ১২৯] মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বলেন যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে, তাহলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না।

Kamal Hossain Vs. State, 61 DLR 505 মামলায় উচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, “The unfortunate mature girl mixed with appellant consciously at her own peril and this appellant though knew the fate of the victim girl, took that opportunity of free consent and mixing which does not fall within the purview of any legal action”.

Abed Ali vs. State [34 DLR (1982), 366] মামলায় উচ্চ আদালত বলেছেন যে, আসামী সংশ্লিষ্ট স্ত্রীলোকটিকে এরুপভাবে বিশ্বাস করতে ও মানতে বাধ্য করবে যে, আসামীর সাথে উক্ত স্ত্রীলোকটির যেন সত্যিই বিয়ে হয়েছে এবং সেই বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে আসামীর সাথে যৌনমিলনে সামিল হয়েছিল এবং আসামীর আগাগোড়াই জানা ছিল যে প্রকৃত প্রস্তাবে উক্ত স্ত্রীলোকটির সাথে তার কোন আইনসম্মত বৈধ বিয়ে হয়নি এবং এরূপ জানা স্বত্বেও আসামী উক্ত স্ত্রীলোকটিকে সত্যিকারের বিবাহ হয়েছে মর্মে বিশ্বাস স্থাপন করায় এবং যৌনমিলনে সামিল করে। অভিযোগকারী পক্ষকে মামলায় অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, এইক্ষেত্রে কোন ধরণের বিয়ে সংঘটিত হয়েছিল যা কোনো বৈধ বা আইনসম্মতভাবে ঘটায়নি। আসামী কর্তৃক কোনো স্ত্রী লোককে শুধুমাত্র বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিলে তা দ্বারা কোনো স্ত্রী লোকের মনে এ ধারণা জন্মাতে পারেনা যে সে আসামীর আইনত বিবাহিত স্ত্রী।

উচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্তসমূহ পর্যালোচনা করলে সহজেই অনুমেয় যে, প্রাপ্তবয়স্ত ব্যক্তিদ্বয়ের মধ্যে সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না।

ভারতীয় আদালতের সিদ্ধান্ত :
অন্যদিকে, বোম্বে হাইকোর্ট একটি মামলায় সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, শিক্ষিত ও প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের ক্ষেত্রে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। মামলার রায়ে বোম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি মৃদুলা ভাটকার বলেন, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে যৌন সম্পর্ক যদি সেই মুহূর্তে উভয়ের সম্মতিতেই হয়ে থাকে, তা হলে তা কীভাবে ধর্ষণ হবে? তিনি বলেন, নিজেদের ইচ্ছাতেই প্রেমিক-প্রেমিকা অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকেন। পরে আবার অনেকেই এটাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে তোলেন। এটা হওয়া উচিত নয়। বিচারপতি বলেন, সমাজ এখন আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অতীতে বিয়ের আগে কোনো মেয়ে বা ছেলে যৌন সম্পর্ক রাখতেন না। সেটা সমাজের চোখে অপরাধ ছিল। কিন্তু এখনকার যুবসমাজ অনেক বেশি খোলা মনের। নিজেদের ইচ্ছাতেই তাঁরা প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকেন। পরে আবার অনেকেই এটাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করেন। এটা হওয়া উচিত নয়। কারণ, বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কের পরিণাম কী হতে পারে, তা একজন শিক্ষিত ও প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে অবশ্যই জানবেন। তাই সব ক্ষেত্রেই এমন ঘটনাকে ধর্ষণের পর্যায়ে ফেলা উচিত হবে না। বিচারপতি আরও বলেন, তার মানে যদিও এই নয় যে প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিক্ষিত মেয়েদের আনা সব অভিযোগকে আগে থেকেই অস্বীকার করা হবে। কোনটা ধর্ষণ আর কোনটা ধর্ষণ নয়, তা অবশ্যই পরিস্থিতির বিচারে স্থির করা হবে। এর আগে এক আদেশে আদালত বলেছিলেন, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও শিক্ষিত নারীকে বিয়েপূর্ব যৌন সম্পর্কের পরিণতি সম্পর্কে জানতে হবে।


প্রযুক্তিগত বোকামি ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত

  ইন্টারনেট ১৯৬৯ সালে আবিস্কৃত হয়। গত ১৯৯৫ সালে ইন্টারনেট বাণিজ্যিক বা কর্পোরেট পন্য হিসেবে আবির্ভূত হয়ে চলমান রয়েছে। গত ১৯৯০ দশকে টেলিফো...