বছর কয়েক ধরে ব্যাংকিং সেক্টরে একটা আইনগত বিষয় নিয়ে বেশ বিতর্ক চলে আসছিল। আর তা হলো- কোন ব্যাক্তি কোন ব্যাংকে বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কোন আমানত রেখে মারা গেলে তা তাঁর মৃত্যুর পর সে আমানতের টাকা কে পাবে? মৃত ব্যাক্তির মনোনীত ব্যক্তি (নমিনি) নাকি তাঁর উত্তরাধিকারী?
এক্ষেত্রে মৃত ব্যাক্তি জীবিত থাকাবস্থায় তাঁর সংশ্লিষ্ট একাউন্টের কোন নমিনি নির্ধারণ করে থাকলে তা তাঁর মৃত্যুর পর বর্তমান প্রচলিত আইন অনুযায়ী উক্ত নমিনিই পাবে। আর যদি একাউন্ট খোলার ফর্মে কোন নমিনির উল্লেখ না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশগণ নিজ উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী রেখে যাওয়া আমানতের ভাগ পাবেন। সেক্ষেত্রে আদালত হতে রেখে যাওয়া আমানত বা অর্থের বিষয়ে সাকসেশন সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হবে।
কিন্তু আমানতকারীর মৃত্যুর পর তাঁর আমানত কখন নমিনিকে; আর কখন উত্তরাধিকারীকে দেওয়া হবে- সে বিষয়ে সুস্পষ্ট আইন ও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে নির্দেশনা থাকলেও হয়রানির শিকার হচ্ছেন নমিনি ও উত্তরাধিকারীরা।
৩ এপ্রিল, ২০১৬ সালে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ এ বিষয়ে একটি ভিন্ন সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। তা হলো- সঞ্চয়পত্রের হিসাবধারী মারা গেলে ওই হিসাবের টাকা নমিনির পরিবর্তে হিসাবধারীর উত্তরাধিকারী পাবেন। তৎকালীন বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি খিজির আহমদে চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চ এমন রায় দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে হাইকোর্টের মত ছিল নমিনি হবেন একজন ট্রাস্টি মাত্র। তবে উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী নমিনি টাকাটা উত্তোলন করে উত্তরাধিকারীদের মাঝে বণ্টন করে দিবেন।
এই রায় প্রকাশের পর মৃত ব্যক্তির ব্যাংকে বা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রেখে যাওয়া অর্থ বিতরণে এক ধরনের ধরণের অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। বিভিন্ন ব্যাংকে মৃত ব্যাক্তির এ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে রাখা হয়। কিন্তু মৃত ব্যক্তির টাকা একদিকে যেমন উত্তরাধিকারীরা দাবি করছিল তেমন আরেক দিকে নমিনিরাও দাবি করছিল। এতে ব্যাংকগুলো কাকে টাকা দিবে সে বিষয়ে কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল।
পরবর্তীতে হাইকোর্টের ঐ রায় আপীল বিভাগ স্থগিত করে দেয়। ফলে প্রচলিত আইনই বহাল থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকও সেই অনুযায়ী সার্কুলার জারী করে এবং দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীর কাছে তা নির্দেশনা আকারে পাঠায়।
যাহোক দেখে নেওয়া যাক বর্তমান প্রচলিত আইন এ বিষয়ে কী বলে :
The Muslim Personal Law (Shariat) Application Act, 1937 এর ২ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মুসলমানদের জন্য উত্তরাধিকার বন্টনের ক্ষেত্রে মুসলিম শরিয়া আইন প্রযোজ্য হবে। অপরদিকে, ব্যাংক-কোম্পানী আইন, ১৯৯১ এর ১০৩ ধারায় আমানতী অর্থ পরিশোধের জন্য মনোনয়ন দান বিষয়ে বলা হয়েছে, ব্যাংক-কোম্পানির নিকট রক্ষিত কোন আমানত যদি একক ব্যক্তি বা যৌথভাবে একাধিক ব্যক্তির নামে জমা থাকে, তাহলে উক্ত একক আমানতকারী এককভাবে বা যৌথ আমানতকারীগণ যৌথভাবে এমন একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে মনোনীত করতে পারবেন যাকে বা যাদেরকে, একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণের সকলের মৃত্যুর পর, আমানতের টাকা প্রদান করা যেতে পারে।
তাছাড়া, Zia Uddin Vs. Arab Bangladesh Bank Ltd., 6 MLR (AD) P.188 এবং 52 DLR (HC), P. 36-এ উল্লেখ আছে, মৃত ব্যক্তির টাকা নমিনিই পাবে। The Muslim Personal Law (Shariat) Application Act, 1937 এবং ব্যাংক-কোম্পানী আইন, ১৯৯১- এই দুইটি আইন বিশেষ আইন। General Clauses Act, 1897 অনুযায়ী, যে বিশেষ আইনটি সর্বশেষ পাশ হয়েছে সেই আইনটি প্রয়োগ হবে। এই ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে ব্যাংক-কোম্পানী আইন, ১৯৯১ সর্বশেষ পাশ হয়েছে। তাই সর্বশেষ আইনটিই এখন প্রয়োগ করা হবে। সুতরাং এখন পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির ব্যাংক এ্যাকাউন্টে রেখে যাওয়া টাকা নমিনি পাবে।
ব্যাংকারদের করনীয় :
বাংলাদেশ ব্যাংকের ১২ জুন, ২০১৭ তারিখের ডিএফআইএম সার্কুলার নং-০২ অনুযায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে রক্ষিত কোন আমানত একক ব্যক্তি বা যৌথভাবে একাধিক ব্যক্তির নামে জমা থাকলে উক্ত একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণের সকলের মৃত্যুর পর তাদের মনোনীত ব্যক্তি/ব্যক্তিদেরকে আমানতের টাকা প্রদান করা যাবে। তবে আমানতকারীগণ যে কোন সময় মনোনীত ব্যক্তির মনোনয়ন বাতিলপূর্বক অন্য কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে মনোনীত করতে পারবেন।
এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৯ এপ্রিল, ২০১৭ তারিখের বিআরপিডি সার্কুলার নং-০৬-এ বলা হয়েছে, “সম্প্রতি এ মর্মে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে যে, কিছু কিছু তফসিলি ব্যাংক আমানতকারীদের মনোনীত নমিনী/নমিনীগণের নিকট হতে এ মর্মে অঙ্গীকারনামা গ্রহণ করছে যে, আমানতকারী/আমানতকারীগণের মৃত্যুর পর তাদের মনোনীত নমিনী/নমিনীগণ মৃত ব্যক্তির হিসাবে রক্ষিত আমানত প্রাপ্তির জন্য যোগ্য/ উপযুক্ত প্রাপক হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারেন, যা ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০১৩ পর্যন্ত সংশোধিত) এর ১০৩ ধারায় বর্ণিত নির্দেশনার পরিপন্থী। বর্ণিত প্রেক্ষিতে, আমানতকারী/আমানতকারীগণের মৃত্যুর পর তাদের ব্যাংক একাউন্টে রক্ষিত আমানতের অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানী আইন, ১৯৯১ (২০১৩ পর্যন্ত সংশোধিত) এর ধারা-১০৩ অনুসরণ করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হলো।”
আবার নমিনি নাবালক হয়ে থাকলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার পক্ষে আদালত হতে অভিভাবক নিযুক্ত হতে হবে। নিযুক্তিয় অভিভাবক নাবালকের পক্ষে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন ও খরচ করবেন এবং আদালতে হিসাব দিবেন।
অর্থাৎ আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে বা দলিলে যা কিছুই থাকুক না কেন, মৃত্যুর পর নমিনিই মৃত ব্যাক্তির গচ্ছিত অর্থ পাবেন।
সব শেষে বলা যায়, সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ কর্তৃক ভিন্ন কোন মত বা সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত আমানতকারীর মৃত্যুর পর আমানতের টাকা তার নির্ধারিত নমিনিকেই প্রদান করতে হবে। এটাই এখন প্রচলিত আইন। তাছাড়া ব্যাংক-কোম্পানী আইন, ১৯৯১ এর ১০৩ ধারার বিধান মতে, নমিনিই মৃত ব্যক্তির আমানতের টাকা পাওয়ার অধিকারী। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে মৃত ব্যক্তির টাকা ধরে রাখা আইনের ব্যত্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়। এক্ষেত্রে সকলে সচেতন হতে হবে এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।