১৯৪৯ সালের ২৩ জুন, আওয়ামী লীগের যেদিন জন্ম শেখ মুজিব সেদিন জেলে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিন্ম বেতনভোগী কর্মচারীরা তাদের দাবী জানিয়ে এক মাসের নোটিশ দিয়ে ১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ থেকে ধর্মঘট শুরু করে। শেখ মুজিবসহ ছাত্ররা এ আন্দোলনে যোগ দেয়। ফলে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল ২৭ ছাত্রকে বহিস্কারসহ জরিমানা করে। শেখ মুজিবের জরিমানা ১৫ রুপি। প্রায় অর্ধেক ছাত্র মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরে পেলেও শেখ মুজিব তাতে রাজী হননি। তার বক্তব্য, ‘আমি কোন অন্যায় দাবী করি নাই, অত্যন্ত ন্যায়সংগত দাবি করেছি। মুচলেকা ও জরিমানা দেওয়ার অর্থ হলো দোষ স্বীকার করে নেওয়া, আমি তা করব না।’ শেখ মুজিব তখন আইন বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র।
ধর্মঘটের কারনে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রেখে ১৭ এপ্রিল খুলে দিলে শুরু হয় আবার ধর্মঘট। ১৮ তারিখ ধর্মঘট শেষে শোভাযাত্রা করে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাহাউদ্দিন চৌধুরী, নাদিরা বেগম, আবদুল ওয়াদুদ এবং শামসুল হুদাসহ ঢাকা মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ শতাধিক ছাত্র ২ ঘটিকায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা প্রদক্ষিণ করে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে জমায়েত হন এবং কিছু ছাত্র বাড়ির দেওয়াল এর ভিতরে প্রবেশ করে শ্লোগান দিতে থাকেন। সন্ধা ৬ ঘটিকায় ছাত্ররা উপাচার্য ভবনের ভিতরে কাউন্সিল হলে সভা করেন। তাতে শেখ মুজিব ঘোষনা করেন, ‘আমরা এখানেই থাকব, যতক্ষন শাস্তিমুলক আদেশ প্রত্যাহার করা না হয়।’ একশ’জন করে ছাত্র রাত দিন উপাচার্যের বাড়িতে বসে থাকার সিদ্ধান্ত হয়। একদল ছাত্র যায়, আর একদল থাকে। ব্যতিক্রম শুধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি জায়গা ছাড়লেন না।
খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসেন এবং ছাত্রদের দাবীর কথা শুনে ৬.৩০ মিনিটে উপাচার্যের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করেন। ছাত্ররা তখন সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কাউন্সিল সদস্যরা উপাচার্যের সাথে আলোচনা করে নিচে এসে আন্দোলন বন্ধ করে ছাত্রদের বাড়ি চলে যেতে বলেন। কিন্তু ছাত্রদের উপর আরোপিত শাস্তি প্রত্যাহারের কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। ছাত্ররা তখন কমিটির সদস্যদের সামনে শুয়ে তাদের বের হয়ে যাওয়ার পথে বাধা দেন ও বিষয়টি নিস্পত্তির আবেদন করেন। ছাত্রদের এমন দাবীর মুখে পরের দিন সকাল পর্যন্ত আলোচনা চালিয়েও পক্ষগনের মধ্যে কোন সমাধান হয়নি। তখনও কমবেশি ২৫ ছাত্র উপাচার্যের বাড়িতে অবস্থান করতে থাকেন।
১৯ মার্চ বিকাল ৩ ঘটিকায় ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপার একদল পুলিশ বাহিনী নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনে হাজির হলেন। এসেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পাঁচ মিনিট সময় দিলেন ছাত্রদের স্থান ত্যাগ করতে। শেখ মুজিব তখন ৮ জন ছাত্রকে বললেন থাকতে আর বাকীদের বাসভবন ছেড়ে যেতে বললেন। তিনিসহ ৮ জন ছাত্র জায়গা ছাড়বেন না বলে জানান। পাঁচ মিনিট পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৫৪ ধারায় শেখ মুজিবুর রহমান, সিরাজুল হক, এ এইচ এম আবদুস সাত্তার, আতাউর রহমান, এ এইচ এম শামসুল হুদা, মোজহারুদ্দিন আহমেদ ও আবু নাসের মোহাম্মদ ওয়াহেদকে গ্রেফতার করেন।
উপাচার্যের বাসভবন হতে গ্রেফতারের পর শেখ মুজিবুর রহমানকে বেশিদিন আটকে রাখা সম্ভব হবে না জেনে ২৯ এপ্রিল বেঙ্গল স্পেশাল পাওয়ার অর্ডিন্যান্স ১৯৪৯ এর ১৮(২) ধারামতে গ্রেফতার দেখিয়ে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেওয়া হয়। এ আটকাদেশ বহাল থাকার মধ্যেই ২৫ মে সরকারী আদেশে তার মেয়াদ বাড়ানো হয়।
জননিরাপত্তা আইনে শেখ মুজিবের আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করে অ্যাডভোকেট এম এ খোন্দকার ঢাকা হাইকোর্টে ২০ ও ২৩ জুন ২টি হেবিয়াস কর্পাস মামলার আবেদন করেন। বিচারপতি মি. এলিস ও বিচারপতি মি. আমীরুদ্দিন আহমদের সমন্ময়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে প্রাথমিক শুনানী শেষে সরকারের উপর মামলার নোটিশ জারী করা হলে তারা সময়ের করেন। সরকারের আবেদনে ১ জুলাই পর্যন্ত মামলার শুনানী মুলতবী করা হয়।
হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস মামলা শুনানীর জন্য অপেক্ষমান থাকাবস্থায় পুর্ব পাকিস্তান সরকার এক আদেশ দ্বারা শেখ মুজিবের আটকাদেশ বাতিল করেন। পরে ২৬ জুন শর্তহীনভাবে শেখ মুজিব ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগার হতে মুক্তি পান।
শেখ মুজিবের মুক্তির তিন দিন আগে ২৩ জুন বেলা ৩ ঘটিকায় কাজী হুমায়ুন বশীর এর বাসভবন ঢাকার কে এম দাস লেনের ‘রোজ গার্ডেন’ এর দোতলার হলঘরে এক রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলন অনুষ্টিত হয়। এ কর্মী সম্মেলনেই ‘পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠন করা হয়। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানিকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সাধারন সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হন। দুজনেরই বাড়ি টাঙ্গাইল। মাওলানা ভাসানী এর আগে ভারতের আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। কৃষকের অধিকার নিয়ে আন্দোলনের কারনে কৃষকনেতা হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। আসামের ‘ভাসানী’ এলাকায় বসবাসের জন্য তার নামের শেষে এ উপাধি যোগ হয়।
এ সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানকে সংগঠনের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মনোনীত করা হয়। শেখ মুজিব জননিরাপত্তা আইনে আটক থাকায় খবরের কাগজে তার নামের পাশে ‘নিরাপত্তা বন্দি’ লিখা হয়। অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান খান, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খান ওরফে বাদশা মিয়া, অ্যাডভোকেট আলী আমজাদ খান, আনোয়ারা খাতুন এম.এল.এ, খয়রাত হোসেন এম.এল.এ, ইয়ার মোহাম্মদ খান, আলমাস খান ও আবদুল আওয়াল আজিজ আহমেদকে সদস্য করা হয়।
‘আওয়ামী লীগ’ নামটি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর দেওয়া। কারাগারে বসে দলের নাম শোনার পর শেখ মুজিবের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া ছিল- ‘পাকিস্তান হয়ে গেছে, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা শুধু ম্যানিফেষ্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনো আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন তারা চিন্তাভাবনা করেই করেছেন।’ পরে অবশ্য মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ২১-২৩ অক্টোবর ১৯৫৩ সালের অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়।
১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে কারাগারে যাওয়ার পরপরই শেখ মুজিবের ছাত্র রাজনীতির অবসান ঘটে। জেল থেকে বের হয়ে সেপ্টেম্বরে পুর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল সভায় ঢাকার তাজমহল সিনেমা হলে শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। সম্মেলনে দবিরুল ইসলাম ও খালেক নেওয়াজ খানকে সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক করে ছাত্রলীগের নতুন কেন্দ্রিয় কমিটি গঠন করা হয়। এটাই ছিল ছাত্রলীগের সঙ্গে শেখ মুজিবের শেষ আনুষ্ঠানিক বৈঠক। সভাপতির ভাষনে তিনি ঘোষনা দেন, যেহেতু তিনি আর ছাত্র নন, তাই এ প্রতিষ্ঠান আর সদস্য হিসেবে থাকবেন না।