সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন সংবাদ মাধ্যম নিয়ে একটি চমৎকার কথা
বলেছেন। তিনি বলেছেন, 'সবার সব নিরাপত্তা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর
নিহিত।' জেফারসনের জন্মভূমি এবং পশ্চিমা বিশ্ব সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
ক্ষেত্রে বহুদূর এগিয়ে গেছে। তাদের সংবাদ মাধ্যমের এ অবাধ স্বাধীনতা এক
দিনে হয়নি; বহু সংগ্রামের ইতিহাস পার করেই তারা সংবাদ মাধ্যমকে এ অবস্থানে
নিয়ে আসতে পেরেছেন। যদিও ইসলাম প্রশ্নে তারা অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে
থাকেন। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে সংবাদ মাধ্যম সম্পূর্ণ স্বাধীন। সেখানে
সরকারি হস্তক্ষেপ নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে বহু টেলিভিশন চ্যানেল যাত্রা শুরু করেছে। তার
বেশিরভাগ সংবাদনির্ভর। যদিও বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে এতগুলো চ্যানেল থাকা
যুক্তিযুক্ত কিনা- তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। চ্যানেলের পাশাপাশি রয়েছে
ভুঁইফোড় অনলাইন পত্রিকা। সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে অশ্লীলতা
ভর্তি, গাঁজাখুরি গল্প ফেঁদে এসব অনলাইন পত্রিকা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের
চেষ্টা করে থাকে। মূলধারার সংবাদ মাধ্যম হয়ে গেছে বিজ্ঞাপননির্ভর।
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদপত্রের প্রথম পাতার অর্ধেকই থাকে বিজ্ঞাপন;
এছাড়া অন্যসব পাতায়ও থাকে বিজ্ঞাপনের প্রাধান্য। তাদের প্রাধান্য এমনই যে,
পত্রিকা পড়তে গেলে সবার আগে দৃষ্টি চলে যায় বিজ্ঞাপনে। সংবাদপত্রকে লাভজনক
করার জন্যই এমন নির্ভরতা। সংবাদপত্রকে শুধু ব্যবসার একটি মাধ্যম হিসেবে
দেখলে চলে না। সংবাদপত্রের একটি সামাজিক দায় রয়েছে। এ দায়টা হলো কোনো তথ্য
জানার অধিকার থেকে পাঠককে বঞ্চিত না করা। তখনই চলে আসে সংবাদ মাধ্যমের
স্বাধীনতার প্রশ্নটি। এ প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ বা না বলা যাবে না। তবে
বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাদ দিলে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ
করতে পারছে। বলা বাহুল্য, এখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিটিভি এবং বাংলাদেশ
বেতার অন্তর্ভুক্ত নয়। আমরা প্রায়ই দেখতে পাই, সরকারি মন্ত্রী, উপদেষ্টা,
প্রভাবশালীদের বিপক্ষে যায় এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করলে সাংবাদিক এবং
সংবাদকর্মীদের সমালোচনা করেন, অকথ্য ভাষায় গালি, হুমকি দেন। আমাদের দেশে গত
কয়েক বছরে কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যা সংবাদ মাধ্যমের
স্বাধীনতার ওপর আঘাত। এছাড়াও বাংলাদেশে যখন সামরিক শাসন ছিল তখনও
সংবাদপত্রের ওপর ছিল নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল। এসব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি
হওয়ার পরও সংবাদকর্মীরা নিরলস কাজ করে থাকেন। বাংলাদেশের মতো দুর্বল
গণতান্ত্রিক দেশে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণটি
রাজনৈতিক। রাজনৈতিক কারণ এজন্য যে, সরকারের যুক্তিযুক্ত সমালোচনা,
ভুল-ত্রুটি তুলে ধরার দায়িত্ব বিরোধী দলের। বাংলাদেশের সব বিরোধী দল এই
একটি জায়গায় ব্যর্থ। সব বিরোধী দলই এ পর্যন্ত সরকারের যথাযথ সমালোচনা করতে
ব্যর্থ হয়েছে। তাদের সমালোচনার মধ্যে থাকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা।
তারা সংসদে যান না। জনগণের দাবি নিয়ে কথা বলেন না। বাংলাদেশের সব সংবাদ
মাধ্যম এই জায়গায় সফল। দেশের যথাযথ চিত্র তুলে ধরে, জনগণের চাওয়া-পাওয়া
তুলে ধরে, সরকারের যুক্তিযুক্ত সমালোচনা করে তারা যথাযথ বিরোধী দলের
ভূমিকায় নিজেকে স্থাপনের চেষ্টা করেছে।
বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর কম আঘাত আসেনি। ইতিহাস তার
নীরব সাক্ষী। বাংলাদেশ সংবিধানে সংবাদপত্রের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা নিশ্চিত
করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৩ সালে প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স
অ্যাক্টের মাধ্যমে জেলা প্রসাশকের হাতে সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়ার ক্ষমতা
দেয়া হয়। ওই সময় চারটি বাদে বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। যার ফলে
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ে। অবশেষে ১৯৯১ সালে তৎকালীন
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের সময়ে এ আইনটি বাতিল করা
হয়। আর সামরিক শাসন চলাকালীন বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তেমন ছিল না।
১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল লাগাতার সংবাদপত্র ধর্মঘটের কারণে।
সাংবাদিকরা সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন স্বৈরাচারের পতন হলেই সংবাদপত্র
প্রকাশিত হবে। এক সপ্তাহ পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ থাকে, অবশেষে ৬ ডিসেম্বর
এরশাদের বিদায়ের পর আবার পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কাজেই সংবাদ মাধ্যমের
স্বাধীনতা ছাড়া একটি দেশের গণতন্ত্র সঠিক এবং অর্থবহ হয়ে ওঠে না। একটি
দেশের আয়না হচ্ছে সে দেশের গণমাধ্যম।
বাংলাদেশের জন্য আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ ধারায় সংবাদ
মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, (১) চিন্তা এবং
বিবেকের স্বাধীনতা দান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি
রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার
স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে
আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে- (ক) প্রত্যেক
নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদ মাধ্যমের
স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।
সংবিধানের ২ উপধারাটিকে যদি আমি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও এখানেও কিছু শর্ত মানতে হবে।
সেগুলো হলো- এমন কিছু সংবাদ মাধ্যমে আসতে পারবে না; যার জন্য রাষ্ট্রের
নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। এমন কিছু প্রকাশ করা যাবে না; যার জন্য
বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে। জনশৃঙ্খলা
বিঘি্নত হয়- এমন তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। অশালীন এবং অনৈতিক কিছু সংবাদ
মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না, সবসময় আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং
এমন কিছু প্রকাশ করা যাবে না, যার জন্য কেউ অপরাধ করার জন্য প্ররোচিত হতে
পারে।
এসব শর্ত মেনে নিয়েই গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়ে থাকে। এসব শর্তের লঙ্ঘন
হলে আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ সংবিধানের এ ধারাটি
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পেছনে গভীর তাৎপর্য বহন করে। কারণ বাংলাদেশে এখন
যতটুকু স্বাধীনতা বিদ্যমান, তার প্রায় পুরোটাই সম্ভব হয়েছে সংবিধানে এ
ধারাটি যোগ করে। সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে যেমন মত প্রকাশের
স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে; তেমনি গোপনীয়তার অধিকারের কথাও বলা হয়েছে। মত
প্রকাশ করতে গিয়ে এমন কিছু করা উচিত নয়; যার জন্য একজন ব্যক্তির স্বাধীনতা
ব্যাহত হয়। জানার অধিকার এবং গোপনীয়তার অধিকারের মধ্যে সবসময় একটি ভারসাম্য
রেখে চলতে হয়।