নাগরিকের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার
দেশের প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার আছে। এই অধিকার
নাগরিকের মৌলিক অধিকার। আর মৌলিক অধিকার হচ্ছে নাগরিকের সেই অধিকার যা
কিনা রাষ্ট্র সুরক্ষা দিতে বাধ্য। কোন নাগরিকের মৌলিক অধিকার খর্ব হলে
সেক্ষেত্রে যথাযথ আদালতের মাধ্যমে তার প্রয়োগ হতে পারে। সংবিধানে
হাইকোর্টের ওপর এ দায়িত্ব ন্যাস্ত করা আছে। উচ্চ আদালতে কোন নাগরিক রিট করে
তার অধিকার ভঙ্গ হলে তা প্রয়োগের জন্য আবেদন করতে পারে।
সচেতন মানুষ অনেকেই এই কথাগুলো জানে। কিন্তু এই স্বাধীনতা পূর্ণ ভোগ করা
যাবে নাকি এতে কোন সীমাবদ্ধতা আছে তা জানেনা। অধিকার প্রশ্নে বাঙালি
বরাবরই সোচ্চার; তা শুধু এখন নয় আদিকাল থেকে। আর অধিকার আদায় করতে পারে
বলেই আমরা একটি সতন্ত্র ভাষা এবং স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জনের মাধ্যমে একটি
সংবিধান পেয়েছি।
সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার অংশে ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের
স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। অনুচ্ছেদটিতে বলা
হয়েছে,’ ‘ ‘(১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। (২)
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক,
জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে আদালত- অবমাননা, মানহানি বা
অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত
বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব-প্রকাশের স্বাধীনতার
অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার, নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
তাহলে অনুচ্ছেদটি পাঠে বুঝা গেলো নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশ বা মত
প্রকাশে পূর্ণ স্বাধীনতা নেই। এখানে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ
করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে মত প্রকাশের ফলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী
রাষ্ট্রসমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা
নৈতিকতার স্বার্থে আদালত- অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা
সম্পর্কে করা আইনে আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ মেনেই কেবল মত প্রকাশ করা
যাবে।
পাঠকের মনের নানাবিধ প্রশ্নের সমাধানে এখানে এই কথা উল্লেখ করা দরকার,
মৌলিক অধিকার কোন সময় নিরঙ্কুশ নয়, সবসময় কিছু শর্তের অধীন হয়ে থাকে। অবাধ
ভোগের নিশ্চয়তা দিলে সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
কল্যাণ রাষ্ট্রে কোন ব্যক্তির অবাধ বা নিরঙ্কুশ অধিকার থাকে না। কারন
কল্যাণ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো জনকল্যাণ, আর তাই জনস্বার্থকে
ব্যক্তিস্বার্থের উপরে স্থান দেয়া হয়। সুতরাং সংবিধানে ঘোষিত মৌলিক
অধিকারগুলোর উপর যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ আরোপ করা যায়।
আইনে একটি শব্দ আছে নজির বা দৃষ্টান্ত; ইংরেজিতে যাকে বলে Precedent।
একই ধরনের মামলার ঘটনায় উচ্চ আদালতের মীমাংসিত কোন ঘটনার রায়কে নজির হিসেবে
আদালতে উপস্থাপন করে মীমাংসিত মামলার একই রায় প্রত্যাশা করা। এমন মামলার
নজির যে শুধু নিজের দেশের হতে হবে তা নয়, পার্শ্ববর্তী দেশসহ অন্য কোন
দেশকে টেনে আনা যায়। কথাটি একারণে বলছি মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনুচ্ছেদটি
আরো ব্যাখ্যা করার স্বার্থে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কিছু মামলার রায়ের নজির
টানছি।
“কিন্তু যেখানে কবি শ্রমিক শ্রমিকদের লক্ষ্য করিয়া বলিতেছেন যে’
‘শ্রমিকগণ, বিপ্লবের বানী তোল। তোমাকে শোষণ করা হইয়াছে, পূর্ণভাবেই এখন
ধ্বংস করিতে হইবে এবং তৎপর নতুন পৃথিবী আসিবে।’ এই উক্তিসমূহ রাষ্ট্রীয়
নিরাপত্তার প্রতিকূলে, সুতরাং কবি শাস্তির যোগ্য।” [ এ ১৯৪১ পাটনা ১৩২]
‘’ ‘জনশৃঙ্খলা বলতে জন নিরাপত্তাও বুঝায়।‘’’’ [১৯৫০ এস সি আর ৫৯৪]
‘মানহানিকর উক্তি দণ্ডবিধি আইনে ৪৯৯ এবং ৫০০ ধারায় অপরাধ। বাকস্বাধীনতার মৌলিক অধিকার মানহানিকর উক্তিকারীকে রক্ষা করে না।’’
[এ আই আর ১৯৫১ কলিকাতা ১৭৬]
যদি কোন নাগরিক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে আদালত-
অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত
যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ ছাড়া কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে
তার মত প্রকাশে বাধার সম্মুখীন হন সেক্ষেত্রে তিনি আদালতে শরণাপন্ন হতে
পারেন। কারন রাষ্ট্র সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলোর স্বীকৃতি দিয়েই
ক্ষান্ত হয়নি, তার সাথে সাথে সেই অধিকার কার্যকর করার দায়িত্বও গ্রহণ
করেছে। সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে, (অনুচ্ছেদ- ১০২ এর ১) “কোন সংক্ষুব্ধ
ব্যক্তির আবেদনক্রমে এই সংবিধানের তৃতীয় ভাগের দ্বারা অর্পিত অধিকারসমূহের
যে কোনো একটি বলবৎ করিবার জন্য প্রজাতন্ত্রের বিষয়াবলীর সহিত সম্পর্কিত
কোনো দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিসহ যে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে হাইকোর্ট
বিভাগ উপযুক্ত নির্দেশাবলী বা আদেশাবলী দান করিতে পারিবেন।”