ইভটিজিং বা উত্যক্ততা
শায়লা : ইভটিজিং কি ?
উকিল : ইভটিজিং বলতে কোন মানুষকে বিশেষ করে কোন নারী বা কিশোরীকে তার স্বাভাবিক চলাফেরা বা কাজ কর্ম করা অবস্থায় অশালীন মন্তব্য করা, ভয় দেখানো, তার নাম ধরে ডাকা এবং চিৎকার করা, বিকৃত নামে ডাকা, কোন কিছু ছুঁড়ে দেয়া, ব্যক্তিত্বে লাগে এমন মন্তব্য করা, ধীক্কার দেয়া, তার যোগ্যতা নিয়ে টিটকারী দেয়া, তাকে নিয়ে অহেতুক হাস্যরসের উদ্রেক করা, রাস্তায় হাটতে হাটতে ধাক্কা দেয়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা দেয়া, সিগারেটের ধোয়া গায়ে ছাড়া, উদ্দেশ্যমূলকভাবে পিছু নেয়া, অশ্লীলভাবে প্রেম নিবেদন করা। উদ্দেশ্যমূলকভাবে গান, ছড়া বা কবিতা আবৃত্তি করা, চিঠি লেখা, পথরোধ করে দাঁড়ানো, প্রেমে সাড়া না দিলে হুমকি প্রদান ইত্যাদিও ইভটিজিং-এর মধ্যে পড়ে। বর্তমানে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগে মোবাইল ফোন এবং ই-মেইলের মাধ্যমেও ইভটিজিং হয়ে থাকে।
শায়লার চাচী : কিন্তু উকিল সাহেব, কেন ছেলেরা এ ধরণের কূরুচিপূর্ণ আচরণ করে ?
উকিল : এক্ষেত্রে আসলে বেশ কিছু কারণের উল্লেখ করা যেতে পারে :
ক) নারীকে পণ্য ও ভোগের বস্তু মনে করা
খ) মূল্যবোধের অবক্ষয় ও প্রকৃত শিক্ষার অভাব
গ) সামাজিক অবক্ষয় ও বৈষম্য
ঘ) বেকারত্ব ও হতাশা
ঙ) সুস্থ সংস্কৃতির অভাব
চ) মাদকের অবাধ ব্যবহার
ছ) আইনের বাস্তবায়ন না হওয়া
জ) আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রকৃত প্রশিক্ষণের অভাব
ঝ) নারীর প্রতি সমাজের (পুরুষদের) নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি
ঞ) রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্যমূলক সম্পর্ক।
শায়লা : ইভটিজিং সম্পর্কিত কি ধরণের আইন আমাদের দেশে প্রচলিত আছে ?
উকিল : ইভটিজিং নিয়ে সরাসরি পৃথক আইন না থাকলেও বিভিন্ন আইনে এ সর্ম্পকে বেশ কিছু ধারা বা অনুচ্ছেদ রয়েছে। ব্যাখ্যা : ১
শায়লা : ইভটিজিং সম্পর্কে পরিবারের দায়িত্ব আছে কি?
উকিল : হ্যাঁ, ইভটিজিং সম্পর্কে পরিবারের দায়িত্ব আছে। যেমন-
পারিবারিকভাবে শিশুকাল থেকে নারী-পুরুষ সম্পর্ক পরিষ্কারভাবে ছেলেমেয়েদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।
পরিবারে নারী সদস্যদের প্রতি পুরুষ সদস্যদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন, মর্যাদা দান, কটু ও অশ্লীল কথা না বলা, গালি-গালাজ না করা উচিত।
পরিবারের সুষ্ঠু শিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গিই মানুষ হয়ে মানুষকে টিজ করা থেকে রক্ষা করতে পারে।
টিজ করা একটি নিম্নমানের খারাপ কাজ এমনকি আইনের চোখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিষয়ে সন্তানদের বিশেষ করে ছেলে সদস্যদের অবগত করানো এবং মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা।
পরিবারের সকল সদস্য বিশেষ করে ছেলে-মেয়েদের বই পড়া, কবিতা পড়া, খেলাধূলার সাথে সম্পৃক্ত করা, ছবি আঁকা ইতাদি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত করার পরিবেশ তৈরি করা।
শায়লা : ইভটিজিং সম্পর্কে সমাজের কোন কর্তব্য আছে কি না ?
উকিল : হ্যাঁ, ইভটিজিং সম্পর্কে সমাজের বেশ কিছু দায়িত্ব আছে। যেমন-
ইভটিজিং এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ক্লাসরুমে ইভটিজিং সম্পর্কে আলোচনা করা এবং নেতিবাচক বিষয় তুলে ধরা।
গণমাধ্যমে ইভটিজিং উৎসাহিত হয় এ ধরনের বক্তব্য, বিজ্ঞাপন কঠোরভাবে প্রচার না করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
সামাজিকভাবে কোথায় কোন ঘটনা ঘটলে ভিকটিমের পাশে সকল সামাজিক- সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে দাঁড়ানো এবং মানসিক ও অন্যান্য সাহস জোগানো।
আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সচেতন ও কার্যকর করা।
সামাজিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ইভটিজিং প্রতিরোধে কমিটি গঠন ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা।
শায়লা : শুধু কি অল্প বয়সী মেয়েরাই ইভটিজিং-এর শিকার হয় ?
উকিল : না, বরং;
কিশোরী মেয়ে, শিশু, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্রীবৃন্দ, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত নারী শ্রমিকরা (গার্মেন্টস শ্রমিক, দর্জি শ্রমিক, গৃহ শ্রমিক)।
বিভিন্ন অফিসে কর্মরত নারী কর্মচারী, কর্মকর্তা, আইনজীবী, সাংবাদিক, ডাক্তারসহ সকল স্তরের নারীরা।
পথ শিশু (ছেলে শিশু)।
হিজরা সম্প্রদায়, শরীরিক প্রতিবন্ধি।
বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার নারীরা।
এরপর, শায়লা ঐ ছেলেগুলোর বিরুদ্ধে ইভটিজিং এর মামলা করে এবং ছেলেগুলো ধরা পড়ে শাস্তি ভোগ করে।
সচরাচর জিজ্ঞাসা
প্রশ্ন ১ : ইভটিজিং বা উত্যক্ততা কি একটি ফৌজদারী অপরাধ ?উত্তর : বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইনের ৫০৯ এবং ২৯৪ আইন অনুযায়ী ইভটিজিং বা উত্যক্ততা বা অশালীন অঙ্গভঙ্গি করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যার জন্য একজন অপরাধীর জেল-জরিমানা হতে পারে। এছাড়া ডিএমপি এ্যাক্টের ৭৫, ৭৬ ধারা অনুযায়ীও এটি একটি অপরাধ এবং এর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে।
প্রশ্ন ২ : ইভটিজিং বন্ধে কারা কারা ভূমিকা রাখতে পারেন ?
উত্তর :
পরিবারের সদস্য একে অপরকে সচেতন করতে পারে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীগণ টিজিং বন্ধে ভূমিকা রাখতে পারেন।
রাস্তা ঘাটে চলাচলকারী যে কোন নাগরিক টিজিং বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন।
আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিটি সদস্য সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন।
আমি-আপনি সকলেই আমরা এই নোংরা ব্যাধির বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে পারি।
প্রশ্ন ৩ : ইভটিজিং এ শুধু কি ছেলেদের দোষ? মেয়েদের কোন ভূমিকা নেই ?
উত্তর : ইভটিজিং সাধারণত: ছেলেরা মেয়েদের প্রতি করে থাকে। এর কারণ আমাদের সমাজে মেয়েদেরকে ছোট করে দেখার প্রবণতা। যদি পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকতো বা মেয়েদের মানুষের সম মর্যাদার মনে করা হতো তাহলে ইভটিজিং হতো না। আমাদের কৃষ্টি- সংস্কৃতি এ রকম নয় যে মেয়েরা ছেলেদের উত্যক্ত করবে। ছেলেরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও ইচ্ছেমত পোষাক-পরিচ্ছেদ পরতে পারলেও নারীদের এসব ক্ষেত্রে স্বাধীনতাকে অনেকে ইভটিজিং এর প্ররোচনা বলে মনে করেন যা দুর্বল ও দরিদ্র মানসিকতার পরিচায়ক।
ইভটিজিং বা উত্যক্ততা : ব্যাখ্যা
ব্যাখ্যা : ১◊ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে ‘‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না’’ বলা হয়েছে এবং ৩৬ অনুচ্ছেদে ‘‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে’’ বলা হয়েছে। ফলে কোন নারী যদি রাস্তায় বা কর্মক্ষেত্রে টিজিং-এর শিকার হন তাহলে তা সংবিধানে দেওয়া অধিকার খর্ব বলে ধরে নেয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন আইনেও ইভটিজিং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ২৯৪ ধারায় বলা হয়েছে ‘‘যে ব্যক্তি, অন্যদের বিরক্তি সৃষ্টি করিয়া (ক) কোন প্রকাশ্য স্থানে কোন অশ্লীল কার্য করে অথবা (খ) কোন প্রকাশ্য স্থানে বা সন্নিকটে কোন অশ্লীল গান, গাঁথা সঙ্গীত বা পদাবলী গায়, আবৃত্তি করে বা উচ্চারণ করে; সেই ব্যক্তি যে কোন বর্ণনায় কারাদন্ডে যাহার মেয়াদ ৩ মাস পর্যন্ত হইতে পারে বা অর্থদন্ডে বা উভয়দন্ডে দন্ডনীয় হবে’’ এই আইনটি প্রয়োগের অভাব পরিলক্ষিত হয়। এই আইন দ্বারা ছোট ছোট ঘটনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা সম্ভব।
বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৫০৯ ধারা অনুযায়ী ‘‘যে ব্যক্তি কোন নারীর শালীনতার অমর্যাদা করার অভিপ্রায়ে এই উদ্দেশ্যে কোন মন্তব্য করে, কোন শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি করে বা কোন বস্তু প্রদর্শন করে যে উক্ত নারী অনুরূপ মন্তব্য বা শব্দ শুনতে পায় অথবা অনুরূপ অঙ্গভঙ্গি বা বস্তু দেখতে পায়, কিংবা উক্ত নারীর নির্জনবাসে অনধিকার প্রবেশ করে, সেই ব্যক্তি ১ বৎসর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন’’। দন্ডবিধি আইনের এই ধারাটির কার্যকর বাস্তবায়ন হলে ইভটিজিং অনেকাংশে কমে যেত।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশেও ইভটিজিং বা উত্যক্ততা বিষয়ে বলা হয়েছে। এই অধ্যাদেশের ৭৬ ধারায় বলা হয়েছে ‘‘যদি কেউ কোন রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে বা সেখান হতে দৃষ্টিগোচরে স্বেচ্ছায় এবং অশালীনভাবে নিজদেহ এমনভাবে প্রদর্শন করে যা কোন গৃহ বা দালানের ভিতর থেকে হোক বা না হোক কোন মহিলা দেখতে পায় বা স্বেচ্ছায় কোন রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে কোন নারীকে পীড়ন করে বা তার পথ রোধ করে বা কোন রাস্তায় বা সাধারনের ব্যবহার্যস্থানে কোন অশালীন ভাষা ব্যবহার করে, অশ্লীল আওয়াজ, অঙ্গভঙ্গি বা মন্তব্য করে কোন মহিলাকে অপমান বা বিরক্ত করে তবে সেই ব্যক্তি ১ বৎসর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদন্ডে অথবা ২ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশের ৭৫ ধারায় ‘‘সর্ব সমাজে অশালীন বা উশৃংখল আচরনের শাস্তি হিসেবে তিন মাস মেয়াদ পর্যন্ত কারাদন্ড বা ৫০০ শত টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ড’’- শাস্তির বিধান আছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন -২০০০ এর ১০ (২) ধারা অনুযায়ী ইভটিজিং-এর শাস্তির বিধান থাকলেও ২০০৩ সালে সংশোধনের মাধ্যমে এই ধারাটি সম্পূর্ণ তুলে দেয়া হয়েছে। তবে কোন ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত কোন কাজ দ্বারা সম্ভ্রমহানির প্রত্যক্ষ কারণে কোন নারী আত্মহত্যা করলে তার শাস্তির বিধান এই আইনের ৯ (ক) ধারায় রাখা হয়েছে যা সর্বোচ্চ ১০ বৎসর এবং অন্যূন ৫ বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবে।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ৩৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘‘অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ সকল প্রকার যৌন নিপীড়ন এবং যৌন নির্যাতন থেকে শিশুকে রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকবে। তা প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ জাতীয়, দ্বিপাক্ষিক এবং বহু পাক্ষিক সকল প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।” এই অনুচ্ছেদে অশ্লীল যৌন আচরণ বা বিষয়বস্তুতে শিশুদের অপব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে ও পদক্ষেপ নিতে রাষ্ট্রকে আহবান জানানো হয়েছে।