প্রসঙ্গ মৌলিক অধিকার
অধিকার বলতে কোন সত্ত্ব বা দাবীকে বুঝায়। কিন্তু এই দাবী যতক্ষণ না
স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হয় ততক্ষণ অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় না। সমাজের
মধ্যেই এই স্বীকৃতির ব্যবস্থা হয়। তাই বলা যায় অধিকার হল একটি সামাজিক
ধারনা। রাষ্ট্র সমাজের পক্ষে আইনের মাধ্যমে এই অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় ও
সংরক্ষণ করে। যেমন আমার বাড়ি, আমার গাড়ি একান্তই আমার এবং এইগুলো ভোগ করার
অধিকারও আমার আছে। যেহেতু এই দাবীগুলো আইন সমর্থন করে সেহেতু এইগুলো আমার
অধিকার। যদি কেউ অন্যায়ভাবে আমার বাড়িটি দখল করতে আসে অথবা আমার গাড়িটি কেউ
চুরি বা ছিনতাই করে নিয়ে যায় তাহলে রাষ্ট্র আমার পাশে দাঁড়ায়। আমার অধিকার
আমাকে ফিরিয়ে দেয় এবং দখলদারকারি বা ছিনতাইকারিকে শাস্তি প্রদান করে। এই
হলো অধিকার, এবার আসি মৌলিক অধিকার প্রসঙ্গে।
গাজী শামছুর রহমান তাঁর এক গ্রন্থে বলেন, ‘মৌলিক অধিকার বলতে সেই সব
জন্মগত অবিচ্ছেদ্য অধিকার বুঝায়, যেসব অধিকারে মানুষ তার আপন সত্তার পূর্ণ
বিকাশের জন্য এবং তার স্বকীয় আদর্শ বাস্তবায়নের পথে অবাধ কার্যক্রম গ্রহণ
করতে পারে এবং এই সহজাত ও অর্জিত ক্ষমতার পূর্ণ ও অবাধ ব্যবহার করতে
পারে।’
মানুষ কিছু সহজাত বৃত্তি নিয়েই জন্ম গ্রহন করেছে। এই বৃত্তিগুলো
স্বাভাবিক, অপরিহার্য ও চিরন্তন। মানুষ কথা বলতে পারে, গাইতে পারে,
চিন্তাভাবনা করতে পারে, এইগুলো সহজাতভাবে সৃষ্টি বলা যায়। এই বৃত্তিগুলো
মানুষের কৃত্তিম সৃষ্টি নয়, এগুলো প্রকৃতির সৃষ্টি, তাই মানুষ এগুলো নষ্ট
করলে সে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যায়। এই বৃত্তিগুলোর সংরক্ষণ ও বিকাশ মানুষের
অবিচ্ছেদ্য অধিকার।
আর এন শর্মা তাঁর এক গ্রন্থে বলেন, ‘মৌলিক অধিকার সমাজের বিভিন্ন
ব্যক্তিবর্গের প্রাকৃতিক আইনের আধুনিক রূপ। যা শুধু মানুষের ব্যক্তিত্ব
বিকাশের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয় না বরং কোন একটি জাতির অপরিহার্য শান্তির
অগ্রগতি ও বিশ্বের সমাজের স্থায়ীত্ত্বের জন্য অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়। এর
লক্ষ্য হল সমাজের ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট স্বাধীনতার ঘোষণা যেমন বেঁচে থাকার
অধিকার, বাক ও অনুভূতি প্রকাশের স্বাধীনতা, সুযোগের সমতা, বিশ্বাসের
স্বাধীনতা এবং অন্যান্য।’
যেসব দেশে লিখিত সংবিধান আছে সেই সব দেশে কতিপয় অধিকার সংবিধানে বর্ণিত
থাকে এবং সংবিধানে ঘোষণা দেয়া হয় যে এই সমস্ত অধিকার সাধারণভাবে
অপরিবর্তনীয় এবং মৌলিক। আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে এই সকল অধিকারকে মৌলিক অধিকার
হিসেবে পরিচিত হয়।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘে Universal Declaration of Human Rights গৃহীত হয়।
তারই অনুকরণে পরবর্তিতে বহু দেশ তাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকার সন্নিবেশ করে।
বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার বিধৃত করা হয়েছে। মৌলিক
অধিকারগুলো হলোঃ আইনের দৃষ্টিতে সমতা (অনুচ্ছেদ ২৭), ধর্ম প্রভৃতি কারণে
বৈষম্য (অনু ২৮), সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা (অনুঃ ২৯), বিদেশী খেতাব
প্রভৃতি গ্রহণে নিষিদ্ধকরণ (অনুঃ ৩০), আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার (অনুঃ ৩১),
জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ (অনুঃ ৩২), গ্রেফতার আটক সম্পর্কে
রক্ষাকবচ (অনুঃ ৩৩), জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ (অনুঃ ৩৪), বিচার ও দণ্ড
সম্পর্কে রক্ষণ (অনুঃ ৩৫), চলাফেরার স্বাধীনতা (অনুঃ ৩৬), সমাবেশের
স্বাধীনতা (অনুঃ ৩৭), সংগঠনের স্বাধীনতা (অনুঃ ৩৮), চিন্তা ও বিবেকের
স্বাধীনতা (অনুঃ ৩৯), পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা (অনুঃ ৪০), ধর্মীয়
স্বাধীনতা (অনুঃ ৪১), সম্পত্তির স্বাধীনতা (অনুঃ ৪২), গৃহ ও যোগাযোগের
রক্ষণ (অনুঃ ৪৩), মৌলিক অধিকার বলবৎকরণের অধিকার (অনুঃ ৪৪)।
রাষ্ট্র যদি এই মৌলিক অধিকারগুলোর পরিপন্থী কোন আইন তৈরি করে সেগুলো
বাতিল বলে গণ্য হবে। সংবিধানের মৌলিক অধিকার অংশের শুরুতে অনুচ্ছেদ ২৬ এ
বলা হয়েছে, ‘(১) এই ভাগের বিধানাবলীর সাথে অসামঞ্জস্য সকল প্রচলিত আইন
যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ এই সংবিধান প্রবর্তন হতে সেই সকল আইনের ততখানি
বাতিল হয়ে যাবে। (২) রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সাথে অসামঞ্জস্য কোন আইন
প্রণয়ন করবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হলে তা এই ভাগের কোন বিধানের
সাথে যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হয়ে যাবে।’
আইন বলতে শুধু সংসদীয় আইন বা অধ্যাদেশ বুঝায় না বরং এর সাথে অন্তর্ভুক্ত
আছে রুল, রেগুলেশন, বাই- ‘ল’, বিজ্ঞপ্তি এমন কি সেই সব প্রথা যা কিনা
আইনের মর্যাদা পায়। সুতরাং দেখা যায় যে, বাংলাদেশে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী
কোন রুল বা রেগুলেশনের কার্যকারিতা থাকতে পারেনা।
রাষ্ট্র সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলোর স্বীকৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তার
সাথে সাথে সেই অধিকার কার্যকর করার দায়িত্বও গ্রহণ করেছে। সংবিধানে বলা
আছে, (অনুচ্ছেদ- ১০২ এর ১) “কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদঙ্ক্রমে এই
সংবিধানের তৃতীয় ভাগের দ্বারা অর্পিত অধিকারসমূহের যে কোনো একটি বলবৎ
করিবার জন্য প্রজাতন্ত্রের বিষয়াবলীর সহিত সম্পর্কিত কোনো দায়িত্ব পালনকারী
ব্যক্তিসহ যে কোনো বুক্তি বা কর্তৃপক্ষকে হাইকোর্ট বিভাগ উপযুক্ত
নির্দেশাবলী বা আদেশাবলী দান করিতে পারিবেন।”
মূল কথা হলো, রাষ্ট্র কোন নাগরিকের আবেদনক্রমে মৌলিক অধিকার খর্ব হলে
সেক্ষেত্রে যথাযথ আদালতের মাধ্যমে তার প্রয়োগ হতে পারে। সংবিধানে
হাইকোর্টের ওপর এ দায়িত্ব ন্যাস্ত করা আছে। উচ্চ আদালতে কোন নাগরিক রিট করে
তার অধিকার ভঙ্গ হলে টা প্রয়োগের জন্য আবেদন করতে পারে।
মৌলিক অধিকার কোন সময় নিরঙ্কুশ নয়, সবসময় কিছু শর্তেও অধীন হয়ে থাকে।
অবাধ ভোগের নিশ্চয়তা দিলে সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা
থাকে। কল্যাণ রাষ্ট্রে কোন ব্যক্তির অবাধ বা নিরঙ্কুশ অধিকার থাকে না। কারন
কল্যাণ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো জনকল্যাণ, আর তাই জনস্বার্থকে
ব্যক্তিস্বার্থের উপরে স্থান দেয়া হয়। সুতরাং সংবিধানে ঘোষিত মৌলিক
অধিকারগুলোর উপর যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ আরোপ করা যায়।
সবিশেষে মোটা দাগে একথা বলা বলা যায়, মৌলিক অধিকারগুলো সংবিধানে স্থান
দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, শাসন বিভাগ বা আইন বিভাগ যাতে স্বেচ্ছাচারীভাবে
এগুলো কেড়ে নিতে না পারে, অযাচিত হস্তক্ষেপ না করতে পারে, এগুলোর পরিপন্থী
কোন কাজ যাতে না করতে পারে।