Tuesday, 15 September 2015

আন্তর্জাতিক বনাম দেশীয় শিশু অধিকার আইন ও বাস্তবায়ন

আন্তর্জাতিক বনাম দেশীয় শিশু অধিকার আইন ও বাস্তবায়ন 



শিশুদের অধিকারকে কার্যকরী রূপ দিতে ২০ নভেম্বর, ১৯৮৯ সালে;  জাতিসংঘের সাধারন পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে, "Convention on the Rights of the Child " নামে একটি সনদ গৃহীত হয়। যা এই সনদের ৪৯ অনুচ্ছেদ মোতাবেক  ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৯০ থেকে কার্যকরী হয় । জাতিসংঘ সনদের ঘোষণা  অনুযায়ী "recognition of the inherent dignity and of the equal and inalienable rights of all members of the human family is the foundation of freedom, justice and peace in the world" অর্থাৎ মানব পরিবারের সকল সদস্যের সহজাত মর্যাদা ও সম অবিচ্ছেদ্য অধিকারসমূহের স্বীকৃতি বিশ্বে স্বাধীনতা, ন্যায়-বিচার ও শান্তির ভিত্তি হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। আবার UDHR এর ঘোষণা অনুযায়ী "everyone is entitled to all the rights and freedoms set forth therein, without distinction of any kind, such as race, color, sex, language, religion, political or other opinion, national or social origin, property, birth or other status " ( অনুচ্ছেদ  ২) অর্থাৎ যে কোন প্রকার পার্থক্য যথা - জাতি, গোত্র, বর্ণ, নারী-পুরুষ, ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক বা অন্য মতবাদ, জাতীয় বা সামাজিক উৎপত্তি, সম্পত্তি, জন্ম, বা অন্য মর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেকেই ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত সকল অধিকার ও স্বাধিকারে স্বত্ববান। এরই উপর দাড়িয়ে আছে " Convention on the Rights of the Child " ।

এর আগে  "Geneva Declaration of the Rights of the Child, 1914 ", " Declaration of the Rights of the Child, 1959  " , " Universal Declaration of Human Rights ", " International Covenant on Civil and Political Rights ( অনুচ্ছেদ ২৩ ও ২৪ ) ", " International Covenant on Economic, Social and Cultural Rights ( অনুচ্ছেদ ১০ )  " শিশু অধিকার সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য উপকরন।

শিশু অধিকার এর প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে "Declaration of the Rights of the Child " এ বলা হয়েছে , " the child, by reason of his physical and mental immaturity, needs special safeguards and care, including appropriate legal protection, before as well as after birth  " । অর্থাৎ যেহেতু শিশুরা শারীরিক ও মানসিক ভাবে অসম্পূর্ণ বা অপরিপক্ব , সেহেতু জন্মের আগে ও পড়ে  তাদেরকে আইনি সুরক্ষা সহ  বিশেষ যত্ন ও নিরাপত্তা দিতে হবে । এছাড়া  "Declaration on Social and Legal Principles relating to the Protection and Welfare of Children" , "United Nations Standard Minimum Rules for the Administration of Juvenile Justice (The Beijing Rules)" , "Declaration on the Protection of Women and Children in Emergency and Armed Conflict "  তে বিশ্ব-নেতাগণ তামাম বিশ্বের নিপীড়িত ও বঞ্চিত শিশুর প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন, এ ব্যাপারে ঐকমত হয়েছেন ।

এরই ধারাবাহিকতায় "Convention on the Rights of the Child " সনদে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তার  বাস্তবায়নে সদস্য দেশগুলির আন্তরিক প্রচেষ্টা আবশ্যকীয়। বাংলাদেশ আগস্ট , ১৯৯০ সালে এই সনদটি অনুমোদন করে। বাংলাদেশে শিশু অধিকারের উপর প্রথম আইন হলো " Bengal Children Act, 1922 ". এরপর  প্রণীত হয় " Children Act, 1974 "যা স্বাধীনতা উত্তর অনেক বছর ধরে প্রচলিত থাকে। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ প্রণীত UNCRC অনুমোদন করা হলে আইনটি ব্যবহারের উপযোগিতা হারায়, মামলা পরিচালনায় দ্বন্দ দেখা দেয়। শিশু অধিকার সম্পর্কিত বিভিন্ন মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে আদালতকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। আদালত নিম্নোক্ত মামলাগুলির মধ্যদিয়ে নতুন আইন ও বিধিবিধান প্রণয়নের প্রয়োজনিতা উপলব্ধি করেন ।

State v Md. Roushan Mondal, 59 DLR 72.
State v Metropolitan Police Commissioner, 60 DLR 660
State –Versus- Secretary, Ministry of Law, Justice and Parliamentary Affairs and others, 29 BLD 656

অবশেষে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে "শিশু আইন, ২০১৩" নামে বহুল কাঙ্ক্ষিত আইনটি আইন সভায় পাস করে ।

আইনের প্রস্তাবনার বলা হয়েছে যে, জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত UNCRC বাস্তবায়নের নিমিত্তে এরূপ আইন প্রণয়ন করা হলো। অতএব, আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, শিশু অধিকার বাস্তবায়নে এই আইনের প্রয়োগে শিশু অধিকারের আন্তর্জাতিক মান ক্ষুণ্ণ হবে না; বরং এর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। অন্যান্য বিধিবিধানের মধ্যে এর বিশেষ বিধানগুলি নিম্নরূপ-
১। এটি একটি বিশেষ আইন বিধায় অন্য যেকোনো আইনে ভিন্নতর যাই বলা থাক না কেন , শিশুদের ক্ষেত্রে এই আইনটিই বলবৎ হবে (ধারা ৩)
২। প্রবেশন কর্মকর্তা নিয়োগ ও তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণ (ধারা ৫(১) এবং ৬ )
৩। জাতীয় শিশু কল্যাণবোর্ড গঠন ও তার কার্যাবলী নির্ধারণ ( ধারা ৭(১) এবং ৭(২) )
৪। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিশুকল্যাণ বোর্ড গঠন (ধারা ৮(১) এবং ৯(১) )
৫। প্রত্যেক থানায় শিশু বিষয়ক ডেস্ক গঠন (ধারা ১৩(১) )
৬। আলাদা চার্জশীট প্রদান  (ধারা ১৫ )
৭। শিশু আদালত গঠন (ধারা ১৬(১) )
৮। গ্রেফতার সম্পর্কিত বিধানবলি ( ধারা ৪৪ এর উপধারা ১,২,৩,৪ এবং ৫ )
৯। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ( ধারা ৫৯ (১,২,৩) )
১০। সুবিধা বঞ্চিত ও আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুদের বিকল্প পরিচর্যার ব্যবস্থা ( ধারা ৮৪ এর 

উপধারা ১,২,৩,৪,৫ এবং ৬ )    এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পরিচর্যা ( ধারা ৮৫ )
নিঃসন্দেহে এটি একটি ভাল প্রচেষ্টা । উক্ত আইনের বিধিবিধানগুলির বাস্তবিক রূপদান করাটাই আমাদের জন্য বর্তমান চ্যালেঞ্জ ।

UNCRC এর ৪৪ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেক সদস্য দেশগুলি সনদ স্বাক্ষরের ২ বছর পর এবং এরপর ৫ বছর পর পর নিজ নিজ "দেশের শিশু পরিস্থিতি ও বাস্তবায়নের অগ্রগতি" সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ । গেল বছর (২০১৪) সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও বিকল্প প্রতিবেদন দেয় " চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ " । কোয়ালিশনের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশমালা প্রদান করা হয়েছে । তার কিছু কিছু নিম্নরূপ -

১। শিশু সনদ অধিকারের যে দুটি অনুচ্ছেদের ( অনুচ্ছেদ ১৪ এবং ২১(১) ) উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা  থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে ।
২। শিশু সুরক্ষা ও আইনের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া শিশুর সুরক্ষা - এ দুটি বিষয়ে অবশ্যই পার্থক্য নিরূপণ করতে হবে।
৩। শিশু দত্তক বিষয়ক একটি স্বচ্ছ ও ইউনিফরম আইনের খসড়া করা ও তা কার্যকরী করা । শিশু দত্তক বিষয়ক  "মুসলিম পারিবারিক আইন" এর প্রয়োজনীয় সংস্কারে আশু পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে ।
৪। পাচার হয়ে যাওয়া শিশুদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া ও তাদেরকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে একটি সমন্বিত তথ্যভাণ্ডার ও মনিটরিং পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে ।
৫। প্রতিবন্ধী শিশুদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ , প্রতিবন্ধীত্বের ধরন ও কারন নিরূপণে জরিপ পরিচালনা করতে হবে ।
৬। শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থের বিষয়টি জাতীয় আইনে ব্যাখ্যা করতে হবে এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাসহ একটি কাঠামো গঠনের মাধ্যমে গৃহীত পদক্ষেপের ফলাফল নিশ্চিত করতে হবে ।
৭। বেশি বেশি কিশোর আদালত স্থাপন করতে হবে । যেখানে বিচারক এবং বিচার কাজে জড়িত কর্তাব্যক্তিগণ শিশু অধিকার বিষয়ে প্রশিক্ষিত হবেন ।
৮। শিশুর ওপর শারীরিক ও মানসিক শাস্তির নেতিবাচক দিক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশে প্রচারণা চালাতে হবে ।   
   " শারীরিক নির্যাতন " আইনে নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ এ বিষয়ে সকল তথ্য নাগরিকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে ।
৯। কর্মজীবী শিশু ও পথশিশুদের জন্য সান্ধ্য স্কুল কর্মসূচী চালু করতে হবে ।
১০। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি পৃথক ডাইরেক্টরেট/বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।


বাংলাদেশ সরকার তাদের সুপারিশমালা বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে সেই দাবীই জানাই। তাছারা শিশুদেরকে নিয়ে কাজ করতে উৎসাহ ও যথেষ্ট সুযোগ প্রদান, আর্থিক সাহায্য প্রদান, দেশীয় ও বৈদেশিক সংস্থাগুলোর সমন্বয় সাধনেই সরকারের কাজের ভার ও চাপ কমাতে ফলপ্রসূ হতে পারে।
যেহেতু শিশুরা নিজে থেকে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্ষম নয় এবং সচেতন নয়, তাই শিশু অধিকার আইনগুলোর অন্যতম বিশেষত্ব হলো সরকার নিজেই শিশুর অধিকার নিশ্চিত ও বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ । UNCRC এ সম্পর্কিত নির্দেশনাও দিয়ে বলেছে যে, শিশুর কল্যাণ ও অধিকার বাস্তবায়নের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সদস্য দেশগুলির। তারাই খুঁজে বের করবে কোন কোন পদক্ষেপে শিশুর সর্বোচ্চ কল্যাণ ও অধিকার সুনিশ্চিত হবে। তবে আমাদেরকেও ভুলে গেলে চলবেনা, সাধারন নাগরিক হিসেবে আমদেরও অনেক কিছু করার আছে; সে সম্পর্কে শিশু আইনসহ UNCRC তেও সুযোগ ও উৎসাহ প্রদান করার কথা বলা হয়েছে। অতএব, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি, দেশীয় বা আন্তর্জাতিক সংগঠন যারা শিশু অধিকারের সাথে সম্পর্কিত বা শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে এবং সর্বোপরি সাধারন নাগরিকের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই শিশু অধিকার বাস্তবায়নের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায়।

প্রযুক্তিগত বোকামি ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত

  ইন্টারনেট ১৯৬৯ সালে আবিস্কৃত হয়। গত ১৯৯৫ সালে ইন্টারনেট বাণিজ্যিক বা কর্পোরেট পন্য হিসেবে আবির্ভূত হয়ে চলমান রয়েছে। গত ১৯৯০ দশকে টেলিফো...